অবিসংবাদিত বীর সিরাজুল আলম খান : শহীদুল্লাহ ফরায়জী - জনতার আওয়াজ
  • আজ সকাল ১০:১৭, বুধবার, ৪ঠা অক্টোবর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১৯শে আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ১৯শে রবিউল আউয়াল, ১৪৪৫ হিজরি
  • jonotarawaz24@gmail.com
  • ঢাকা, বাংলাদেশ

অবিসংবাদিত বীর সিরাজুল আলম খান : শহীদুল্লাহ ফরায়জী

নিজস্ব প্রতিবেদক, জনতার আওয়াজ ডটকম
প্রকাশের তারিখ: সোমবার, জুন ১২, ২০২৩ ১২:২৯ পূর্বাহ্ণ পরিবর্তনের তারিখ: সোমবার, জুন ১২, ২০২৩ ১২:২৯ পূর্বাহ্ণ

 

বাঙালিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা সিরাজুল আলম খান- ঘরে ফেরার আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে না ফেরার দেশে চিরকালের শয্যায় বিরতিহীন ঘুমে আশ্রয় নিয়েছেন। ১৯২২ সালে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু বলেছিলেন, ‘আমরা এ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়াছি একটি উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্তে, একটি বাণী প্রচারের জন্য। আলোকে জগত উদ্ভাসিত করিবার জন্য যদি গগনে সূর্য উদিত হয়, গন্ধ বিতরণের উদ্দেশ্যে বনমধ্যে কুসুমরাজি যদি বিকশিত হয়, অমৃতময় বারিদান করিতে তিমি যদি সাগরাভিমুখে প্রবাহিত হয়- যৌবনের পূর্ণ আনন্দ ও ভরা প্রাণ লইয়া আমরাও মর্তলোকে নামিয়াছি একটি সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য। যে অজ্ঞাত গূঢ় উদ্দেশ্য আমাদের ব্যর্থ জীবনকে সার্থক করিয়া তোলে তাহা আবিষ্কার করিতে হইবে- ধ্যানের দ্বারা, কর্মজীবনের অভিজ্ঞতার দ্বারা।’

তেমনি সিরাজুল আলম খান পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন একটি উদ্দেশ্য সাধনের জন্য, একটি সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য। তিনি বলেছেন, ‘১৯৫৮ সালে আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তখনই আইয়ুব খানের মার্শাল ল’ জারি হয়। লম্বা ছুটিতে আমি দিল্লি বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমার বয়স তখন ১৮। ১৪ই আগস্ট দিল্লিতে পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তান নামের একটি প্রদেশের নাগরিক হওয়াটা কতো যে অসম্মানের বা অপমানজনক ছিল সেদিন তা বুঝতে পেরেছিলাম। পরবর্তীতে ১৯৬২ সালের কথা।

আমার বয়স তখন ২১ বছর। অভিজ্ঞতা ছাড়া শুধুমাত্র তারুণ্যের স্বপ্ন বা আকাঙ্ক্ষাকে সম্বল করে শুরু হয় স্বাধীনতার জন্য আমাদের পথচলা। আমরা দশ বছরের মধ্যে দেশকে স্বাধীন করবো এমন সংকল্প নিয়ে কাজ শুরু করি। তার আগেই অর্থাৎ নয় বছরের মাথায় ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে।’
২১ বছর বয়সে স্বাধীনতার স্বপ্ন বপন করা আর ৩০ বছর বয়সে সে স্বপ্ন পূরণ করেছেন-
পৃথিবীতে এমন দুর্লভ মানুষ খুবই কম আছেন। সিরাজুল আলম খান সেই দুর্লভ সৌভাগ্যবানদের অন্যতম একজন। তিনি জাতীয় পতাকা তৈরির জন্য কাজী আরেফকে যে নির্দেশ দিয়েছিলেন ১৯৭০ সালে, ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ ডাকসুর ভিপি হিসেবে আ স ম আবদুর রব সেই পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে সশস্ত্র যুদ্ধকে অনিবার্য করে তোলেন। ৩রা মার্চ সিরাজুল আলম খানের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায় অনানুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা করা হয়, বিশেষ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে বাঙালির শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, জাতীয় সংগীত নির্ধারণ করা হয়, মানচিত্র খচিত পতাকাকে জাতীয় পতাকা হিসেবে সুনির্দিষ্ট করা হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

স্বাধীনতার জন্য যা প্রয়োজন- গণজাগরণ, গণঅভ্যুত্থান, ছাত্র আন্দোলন, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন, জয় বাংলা বাহিনী গঠন, প্রবাদ-প্রতিম ‘চার খলিফা’র নেতৃত্ব ও মুজিব বাহিনী গঠনসহ স্বাধীনতার লক্ষ্য পূরণে যা যা প্রয়োজন তার সবই নিপুণভাবে সম্পন্ন করেছেন সিরাজুল আলম খান। তিনি বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের অভ্যুদয় এবং বিপুল গণজাগরণের ভাষ্যকার, মহাকাব্যের অন্যতম নায়ক। তিনি এই ভূখণ্ডে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং আবির্ভূত হয়েছেন কেবলমাত্র স্বাধীনতা এবং গণমানুষের মুক্তির জন্য। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন- বাঙালি জাতিকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অধিকারী হতে হবে, হতে হবে শৌর্য বীর্যের অধিকারী। স্বাধীনতার সাধনায় জাতীয় ভাবধারায় জাতিকে জাগরণের মহান ব্রত নিয়ে সিরাজুল আলম খান ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন একাগ্রচিত্তে। খ্যাতির মোহ বা বীরত্বের নেশায় নয়; তিনি সমগ্র জীবনকে উৎসর্গ করেছেন স্বাধীনতার বেদীতে।

সিরাজুল আলম খানের প্রয়াণে সমগ্র জাতি শোকাবিভূত। গণমাধ্যমে বিশেষ করে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় অসংখ্য দুর্লভ ছবিসহ অগণিত ঘটনার বিবরণ প্রকাশ পাচ্ছে। পত্রিকার পাতাজুড়ে বহুমাত্রিক মূল্যায়ন, বিশাল জনগোষ্ঠীর বুকের ভিতর তার শূন্যতা হাহাকার করছে। নির্লোভ, পদ-পদবিবিহীন, সহায় সম্পত্তিহীন সিরাজুল আলম খানের মৃত্যু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে হয়নি। হয়তো সরকারের ভয়, কিছু বললেই বুঝি সিরাজুল আলম খান ইতিহাসের অনেক জায়গা দখল করে নিবেন। কিন্তু সরকার বুঝতে পারেনি ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই দেয়ার জন্য তিনি লালায়িত ছিলেন না। তিনি ইতিহাসের নির্মাতা। বীরের যোগ্য মর্যাদা দেয়ার সাহস প্রদর্শনে রাষ্ট্রের সামর্থ্যকে আমরা বিনষ্ট করে ফেলেছি। বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে পরশ্রীকাতরতার কথা বলেছিলেন। সেই পরশ্রীকাতরতার শিকার হয়েছে আওয়ামী লীগ এবং সরকার। সিরাজুল আলম খানের বীরত্ব বাঙালির মননে-চেতনায় খোদাই হয়ে গেছে। তিনি বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের অন্যতম। তাকে যারা মুছে ফেলতে চেয়েছে তারা দ্রুত মুছে যাবে। সমাজের বিশাল ঘৃণা কুড়াবে, নামহীনভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এবং করুণাযোগ্য হবে।

সিরাজুল আলম খান স্বাধীনতার উদ্দীপ্ত অভিযাত্রী। সর্বস্ব ত্যাগ করে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত স্বাধীনতা ও মানুষের মুক্তির মহৎ উদ্দেশ্য লালন করে গেছেন। তার হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে উৎসারিত বাণী যুগে যুগে জাতিকে অনুপ্রাণিত করবে।

জেনারেল সুজন সিং উবান, সিরাজুল আলম খান সম্পর্ক লিখেছেন- ‘তিনি রেডিক্যাল (আমূল পরিবর্তন) ধ্যান ধারণা পোষণ করতেন। আপসহীন মনোভাবের অধিকারী ছিলেন। যুদ্ধ করতেন ব্যাঘ্রের মতো, কাজ করতেন নিবেদিতপ্রাণ কৃতদাসের মতো। একসঙ্গে অনেকদিন তিনি না খেয়ে, না ঘুমিয়ে শুধু চা পানের উপর নির্ভর করে থাকতে পারতেন। যখন খেতেন খুব ভালো রকম খেতেন। নির্ঘুম রাতের ক্ষতিপূরণ করে নিতেন যখন কাজ থাকতো না তখন দিনের বেলায় দীর্ঘ ঘুম দিতেন। তিনি বক্তৃতা দিতে পছন্দ করতেন না। মুজিব বাহিনীর ছেলেদের উদ্দেশ্যে কিছু বলার জন্য সব সময় তাকে অনুরোধ করা যেতো না, কিন্তু যখন কিছু বলতেন তাতে খুব ভালো কাজ হতো। এমনভাবে কথা বলতেন যে, বোঝা যেতো তিনি কাজের লোক; কথার নন। তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীদের মতো তিনি কথা বলতেন। অপছন্দ করতেন আত্মপ্রচার, নীরবে কাজ করে যেতেন। ছিলেন চিরকুমার। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েকদিন পর ঢাকায় তিনি যখন আমার সঙ্গে দেখা করতে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে এসেছিলেন, সেদিনের কথা আমি ভুলতে পারিনি। তিনি ছিলেন খুব অসুস্থ। গায়ে খুব জ্বর। আমার কক্ষে তাকে নিয়ে আসার জন্য তার বন্ধুদের জোর করেছিলেন। এমনকি লিফটে তাকে দু’জন ধরে রেখেছিল কারণ তিনি ঠিকমতো দাঁড়াতেও পারছিলেন না। এভাবে বিছানা ছেড়ে আসার কারণে আমি যখন তাকে তিরষ্কার করছিলাম তখন তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, আপনাকে আমার শ্রদ্ধা জানানোর এই সুযোগটি কি হারাতে পারি? আপনি আমাদের জন্য ও আমাদের দেশের জন্য এতকিছু করেছেন; মুক্তিযুদ্ধের পর আপনি এখন ঢাকায়, আমি কীভাবে না এসে পারি!

তিনি এমন মানুষ যাকে ভালোবাসতে হয়। তিনি আত্মউৎসর্গের প্রতীক স্বরূপ। আমার শুধু এই ভয় ছিল যে, দারিদ্র্য মুক্তির পথের ধীরগতিতে তিনি সদস্য হতে পারবেন না এবং হয়তো কোনো অগ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে অপ্রিয় হয়ে যাবেন। শেষ পর্যন্ত এই হলো যে, শেখ মুজিবের অধীনে কোনো পদ গ্রহণ করলেন না এবং সরকার বিরোধী একমাত্র নেতা হিসেবে দেখা দিলেন।’

বিখ্যাত সাহিত্যিক-দার্শনিক কহলিল জিবরান বলেছিলেন, ‘আমার ভিতরে অন্য একটা সক্রিয় বুদ্ধিবৃত্তি রয়েছে শব্দ দিয়ে যার করার কিছু নেই, রেখা দিয়েও নয়, রঙ দিয়েও নয়। যে কাজ করার জন্য আমি জন্মেছি; ব্রাশ আর কলমের সেখানে করার কিছু নেই।’

ঠিক সেভাবে সিরাজুল আলম খানের ক্ষেত্রেও বলা যায়- একজন সিরাজুল আলম খান যে প্রয়োজনে জন্মগ্রহণ করেছেন তার বর্ণনায় শব্দের কিছুই করণীয় নেই। তিনি অনন্য মানুষ। ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল সন্তান, তাকে ভালো না বেসে পারা যায় না। তিনি অনন্তকালের গ্রন্থে বেঁচে থাকবেন।

লেখক: গীতিকবি
faraizees@gmail.com

Print Friendly, PDF & Email
 
 
জনতার আওয়াজ/আ আ
 

জনপ্রিয় সংবাদ

 

সর্বোচ্চ পঠিত সংবাদ