উহাদের ‘সুকীর্তি’ এবং কৃতিত্বের কথা কোনটা থুইয়া কোনটা কই?
নিজস্ব প্রতিবেদক, জনতার আওয়াজ ডটকম
প্রকাশের তারিখ:
শুক্রবার, সেপ্টেম্বর ৮, ২০২৩ ৩:৩৪ পূর্বাহ্ণ পরিবর্তনের তারিখ:
শুক্রবার, সেপ্টেম্বর ৮, ২০২৩ ৩:৩৪ পূর্বাহ্ণ

মারুফ কামাল খান
এই আওয়ামী যামানায় পুলিসের দারোগা সাহেবেরাই মার্কিন মুল্লুকে কয়েকশত বাড়ি ক্রয় করিয়াছেন। ইহা লইয়া এক বন্ধুর কাছে টেলিফোনে বিষ্ময় প্রকাশ করিতেই তিনি ধমকাইয়া উঠিলেন। কহিলেন : তুমি দেখি এই বুড়া বয়সেও পুরাই নাদান রহিয়া গিয়াছ। তাইতো তোমার জীবনে কখনোই ‘নুন আনিতে পান্তা ফুরায়’ দশা কাটিল না। আরে মিঞা, এইগুলি হইতেছে এই যামানায় দুর্নীতি-লুট-লোপাটের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের পর্বতমালার কয়েকটি ধুলিকণা মাত্র!
বন্ধুর ধমক খাইয়া অধোবদনে বসিয়া ভাঙাচোরা সেলফোনখানা নাড়াচাড়া করিতেছিলাম। ভাবিতেছিলাম ভাড়া বিদ্যুতকেন্দ্রের নামে আওয়ামী অলিগার্কদের হাতে রাষ্ট্রের লাখো কোটি টাকা তুলিয়া দেওয়া এবং সিঙ্গাপুরের সেরা ধনীর তালিকায় আজিজ খানদের আরেক ধাপ অগ্রগতির রূপকথা। অনলাইনে হঠাৎ করিয়া একটি খবরে চোখ আটকাইয়া গেল। সেইটি পাঠ করিয়া তো আমার চক্ষু একেবারে ছানাবড়া!
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সংবাদ সংস্থা এএফপি’র ফ্যাক্ট চেকিং ডিপার্টমেন্ট সংবাদটি তৈরি করিয়াছে। বাংলাদেশ সংক্রান্ত এই খবরটি আল-জাজিরাও প্রচার করিয়াছে। অনেক তত্ত্বতালাস করিয়া উদঘাটিত সংবাদে এএফপি জানাইয়াছে যে, নির্বাচনকে সামনে রাখিয়া দেশী-বিদেশী অনেক প্রচার-মাধ্যমে বিভিন্ন ভুয়া বিশেষজ্ঞের সাত শতের মতন নিবন্ধ প্রকাশিত হইয়াছে। শেখ হাসিনা সরকারের প্রশংসা এবং তাহার বিরোধীদের সমালোচনা করিয়া রচিত এই লেখাগুলির লেখক এবং তাহাদের নামধাম, কর্মস্থল, গবেষণার বিবরণ, ছবি, তাহাদের ব্যবহৃত রেফারেন্স ও উদ্ধৃতি মায় তাহাদের পিতৃপরিচয় সব কিছুই ভুয়া। ধারণা করা হয় যে, এই সব ভুয়া নিবন্ধ একটি নির্দিষ্ট উৎসে বসিয়া তৈরি করিয়া ভুয়া ও অস্তিত্বহীন লেখকদের মিথ্যা পরিচয়ে বিভিন্ন দেশী-বিদেশী মিডিয়ায় প্রেরণ এবং প্রচার ও প্রকাশের ব্যবস্থা করা হইয়াছে।
এএফপির অনুসন্ধানে অস্তিত্বহীন এমন কিছু বিশেষজ্ঞ লেখকের খোঁজ মিলিয়াছে যাহাদেরকে বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবিদ হিসেবে মিথ্যা পরিচয় দেওয়া হইয়াছে। তাহাদের ছবি হিসাবে চুরি করা বিভিন্ন হেডশট ছবি ব্যবহার করা হইয়াছে এবং তাহাদের নামে প্রচারিত নিবন্ধে অনেক ভুল ও বিকৃত উদ্ধৃতি দেওয়া হইয়াছে।
এএফপির অনুসন্ধানে এই ধরনের সাত শতাধিক নিবন্ধের তথ্য উঠিয়া আসিয়াছে। এইসব নিবন্ধ দেশী-বিদেশী ৬০টি সাইটে ৩৫ জন ব্যক্তির নামে প্রকাশিত হইয়াছে। ইহাদের কাহারও নামধাম ইতোপূর্বে শোনাও যায় নাই। তাহাদের কাহারও অনলাইনে উপস্থিতি বা কোনও আর্টিকেল খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই। এমনকি সোশ্যাল মিডিয়ায়ও উহাদের কোনও প্রোফাইল বা অ্যাকাডেমিক জার্নালে কোনও গবেষণাপত্রও পাওয়া যায় নাই। ইহাদের মধ্যেকার অন্ততঃ ১৭ জন পশ্চিমা ও এশিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততার দাবি করিলেও যাচাই-বাছাইয়ে তাহা ভুয়া প্রমাণিত হইয়াছে।
এএফপির ওই অনুসন্ধানে এমন লেখকদেরও তথ্য মিলিয়াছে যাহাদের বাংলা ও ইংরেজিতে আলাদা নাম ব্যবহার করা হইয়াছে। এইসব ব্যক্তিদের একজন হইলেন ডোরেন চৌধুরী। তিনি যে ছবিটি ব্যবহার করিয়াছেন, তাহা একজন ভারতীয় ফ্যাশন ডিজাইনারের। ডোরেন চৌধুরী নিজেকে নেদারল্যান্ডের গ্রোনিংজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরাল গবেষক হিসেবে পরিচয় দিলেও এ বিষয়ে কোনও তথ্য বিশ্ববিদ্যালয়টিতে পাওয়া যায়নি।
ফুমিকো ইয়ামাদা নামের এক ব্যক্তি ব্যাংকক পোস্ট ও লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের একটি ব্লগে নিবন্ধ লিখিয়াছেন। তিনি নিজেকে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ স্টাডিজের একজন বিশেষজ্ঞ বলিয়া দাবি করিয়াছেন। কিন্তু বাংলাদেশ স্টাডিজ নামের কোনও বিভাগ ওই বিশ্ববিদ্যালয়েই নাই।
পৃত্থীরাজ চতুর্বেদী নামের কোনও এক ব্যক্তির একটি লেখায় নেদারল্যান্ডসের ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল স্টাডিজের অধ্যাপক জেরার্ড ম্যাকার্থির নামে উদ্ধৃতি দেওয়া হইয়াছে। মিয়ানমারের বিষয়ে পশ্চিমা বিশ্বের দ্বৈতনীতি সংক্রান্ত সেই উদ্ধৃতিকে প্রফেসর ম্যাকার্থি নিজেই একদম ভুয়া বলিয়া জানাইয়াছেন।
কিছুদিন পূর্বে শেখ হাসিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন সরকারের পক্ষে লিখিবার জন্য ভালো ভালো কলামিস্ট ভাড়া করার কথা বলিয়াছিলেন। ইহার পর হইতেই ভুয়া ও কল্পিত লেখকদের নামে এইসব নিবন্ধ প্রকাশিত হইতে শুরু করে। এই ব্যাপারে এএফপি মোমেন সায়েবের মন্তব্য জানিতে চাহিলে তিনি তাহার ‘টাইম নাই’ বলিয়া কাটিয়া পড়েন। সরকারের পররাষ্ট্র ও তথ্য মন্ত্রনালয়ের আর কোনও কর্তাব্যক্তিই এই ব্যাপারে মন্তব্য করিতে সম্মত হন নাই। তবে লেখক, তাদের পরিচয় ও নিবন্ধ ভুয়া হইলেও ইহার পেছনে ব্যয় হওয়া অর্থ কিন্তু নিশ্চয়ই ভুয়া নহে। গরীব দেশের হাড্ডিসার নাগরিকদের রক্তচোষা যে অর্থ খাজাঞ্চিখানায় জমা আছে সেখান হইতে কতোটা যে এই ভুয়া প্রকল্পে ব্যয় হইয়াছে তাহার হিসাবও হয়তো একদিন প্রকাশিত হইয়া পড়িবে।
নিশীথের নির্বাচনে ভুয়া ভোটে নির্বাচিত বলিয়া ঘোষিত ভুয়া সরকারের পক্ষে ভুয়া লোকদের এইসব ভুয়া প্রচারের কথা জানিয়া গুম মারিয়া বসিয়া রহিলাম। এইসব করিয়াই তো ইহারা এতোদূর আসিয়াছে। এই রকম জোচ্চুরি, জালিয়াতি, মিথ্যাচার করিয়াই তো ইহারা বিদেশীদের বিভ্রান্ত করিয়াছে এবং দেশের ভিতরে প্রতিদ্বন্দ্বীদের জব্দ করিয়া রাখিয়াছে।
তবে চোরের দশদিন হইলেও সাধুর জন্য একদিন না একদিন আসেই। অবশেষে উহাদের জালিয়াতি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে হাতেনাতে ধরা পড়িল। কিন্তু তাহাতে কি তাহারা লজ্জা বোধ করিবে? জ্বী না। সেই আশায় গুড়েবালি। আওয়ামী লীগ নামক দলটির ডিকশনারিতে ‘লজ্জা’ নামক কোনও শব্দের অস্তিত্ব নাই। বরং তাহাদের ‘কী করিলে কী হইবে’ নামের একখানা চটি বই আছে। উহাতে লিখিত আছে : “কখনও কোনও অপকর্ম করিয়া হাতেনাতে ধরা পড়িলে চাপাবাজির তোড়ে তাহা ঢাকিয়া ফেলিবা”।
মারুফ কামাল খানের ফেইসবুক থেকে
জনতার আওয়াজ/আ আ
