কমিটি গঠনসহ নানা কারণে ভেঙে পড়েছে ছাত্রদলের চেইন অব কমান্ড
নিজস্ব প্রতিবেদক, জনতার আওয়াজ ডটকম
প্রকাশের তারিখ:
শনিবার, জানুয়ারি ১৪, ২০২৩ ৩:২০ অপরাহ্ণ পরিবর্তনের তারিখ:
শনিবার, জানুয়ারি ১৪, ২০২৩ ৩:২১ অপরাহ্ণ

ডেস্ক নিউজ
শীর্ষ নেতাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল-গ্রুপিং, কমিটিতে বিশেষ অঞ্চলকে প্রাধান্য দেওয়া, অর্থের বিনিময়ে কমিটি গঠনসহ নানা কারণে ভেঙে পড়েছে ছাত্রদলের চেইন অব কমান্ড। কমিটির কোনো পদে না থেকেও জেলা ও কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশনা দিয়ে থাকেন ছাত্রদল সভাপতির ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইবরাহিম খলিল এবং সাধারণ সম্পাদকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সিরাজুল ইসলাম। এই দুজনকে বলা হয় ‘ছায়া সভাপতি’ ও ‘ছায়া সাধারণ সম্পাদক’। তাদের অশোভন আচরণে বর্তমান কেন্দ্রীয় নেতা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ইউনিটের নেতাকর্মীরা মারাত্মক ক্ষুব্ধ। সম্প্রতি ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিন সমাবেশের মঞ্চ থেকে ছাত্রদলের কয়েকজন সহসভাপতিকে নামিয়ে দেন ইবরাহিম খলিল। সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণও অধস্তন নেতাকর্মীদের ওপর ক্ষিপ্ত হন। ওই দিনই সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েলের অনুসারী কয়েকজন কর্মরত গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর চড়াও হন। একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সাংবাদিকের জামার কলার ধরতেও দেখা যায়। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। যদিও ছাত্রদল সভাপতি শ্রাবণ গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে তাৎক্ষণিক ক্ষমা চান। পরে ওই ঘটনায় ঢাকা মহানগর উত্তরের ১১ জনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
এদিকে তৃণমূলে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে। ছাত্র রাজনীতির আঁতুরঘর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) সংগঠনটির কার্যক্রম হুমকিতে। তা ছাড়া ছাত্রদলের কমিটি গঠনের পরপরই বর্তমান সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণের একটি আপত্তিকর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় তৃণমূল নেতাকর্মীদের মনোবলও ভেঙে গেছে। ছাত্রদলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কুকর্মের লিখিত অভিযোগ সংগঠনটির সাংগঠনিক অভিভাবক তারেক রহমানের কাছে পাঠানো হয়েছে। ফলে সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলনের আগেই ছাত্রদলের বর্তমান কমিটি ভেঙে নতুন কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছেন তিনি। দলটির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুল দায়িত্ব পাওয়ার পর ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগরীর ইউনিটের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। খুব দ্রুততম সময়ে সার্বিক বিষয়ে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে মূল্যায়ন প্রতিবেদন জমা দেবেন বলে জানা গেছে।
অভিযোগের স্তূপ
দীর্ঘদিন কমিটি পুনর্গঠন ও হালনাগাদ না করায় অভ্যন্তরীণ কোন্দল-গ্রুপিংয়ে নেতৃত্বের বিকাশ ঘটছে না ছাত্রদলে। ২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ছাত্রদলের ষষ্ঠ কাউন্সিলে প্রত্যক্ষ ভোটে ফজলুর রহমান খোকন সভাপতি এবং ইকবাল হোসেন শ্যামল সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এর পর আর কোনো কাউন্সিল হয়নি। সর্বশেষ গত ১৭ এপ্রিল কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণকে (যশোর) সভাপতি, সাইফ মাহমুদ জুয়েলকে (বরিশাল) সাধারণ সম্পাদক করে প্রথমে সুপার ফাইভ এবং গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বরে পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়। তন্মধ্যে শ্রাবণ ও জুয়েলের পুরো পরিবার আওয়ামী লীগের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
ছাত্রদলের বর্তমান কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে জমেছে অভিযোগের স্তূপ। সভাপতি শ্রাবণের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি নিজের অনুগত না হলে খুব বেশি কথা বলেন না। সিনিয়রদের অনুপস্থিতিতে তাদের নিয়ে বিভিন্ন বাজে মন্তব্য করেন। তিনি প্রায় অশালীন ভাষায় গালাগাল করেন। ছাত্রদলের পদ পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে অসংখ্য মেয়ের সঙ্গে মিথ্যা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগও আছে এই নেতার বিরুদ্ধে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি অশালীন ভিডিও ভাইরাল হলে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারাও বিব্রত হন। সম্প্রতি ছাত্রদলের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটের এক নেতা লিখেছেন, ‘উলঙ্গ নেতৃত্ব, বিকলাঙ্গ সংগঠন’। তাছাড়া ইবরাহিম খলিল নামে তার এক বন্ধু নিজেকে ‘সভাপতি’ হিসেবে দাবি করে কমিটি গঠনে প্রভাব খাটান। প্রায় সর্বত্র শ্রাবণের সঙ্গে তার দেখা মেলে।
অভিযোগের বিষয়ে ছাত্রদল সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ কালবেলাকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ ভুয়া। ইবরাহিম আমার বন্ধু। সেজন্য অনেকে অনেক কথা বলে। সে তো কমিটিতেই নেই। সে কীভাবে কেন্দ্রীয় নেতাদের নামিয়ে দেবে? ঢাবিতে ছাত্রদল আসে না কেন? প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভিসি ও প্রক্টরের দাওয়াতে যাওয়ার পর ছাত্রলীগ আমাদের মারল। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে তো নেতাকর্মীরা প্রোগ্রাম করছে।
অন্যদিকে সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েল ওরফে জুয়েল হাওলাদারের বিরুদ্ধেও অভিযোগের কমতি নেই। তার বিরুদ্ধে রয়েছে ছিনতাই ও অপহরণ মামলা। রাজধানীর নিউমার্কেট থানায় একটি অপহরণ মামলায় জুয়েল চার মাস জেল খেটেছেন। (মামলা নং ১২১৫-২৭-০৭-২০০০)। নিজ এলাকার ছেলেদের সর্বাধিক প্রাধান্য দেওয়ায় অনেকেই ছাত্রদলকে ‘বরিশাল সমিতি’ আখ্যা দিচ্ছেন। ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির ৩০২ সদস্যের ১২২ জনই বরিশাল বিভাগের। বরিশাল অঞ্চলের হলেই যে কাউকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদ দিয়েছেন জুয়েল। এতে যোগ্যরা বাদ পড়েছেন। নেপথ্যে কাজ করেছেন জুয়েলের বন্ধু সিরাজুল ইসলাম, যিনি নিজেকে ‘সাধারণ সম্পাদক’ হিসেবেও পরিচয় দেন। তা ছাড়া বিভিন্ন জেলা ও ইউনিট কমিটি গঠনেও পদ এবং অর্থে ভাগ বসান সিরাজ। এসব বিষয়ে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েল বলেন, যারা এ কথাগুলো বলেছে। বিভিন্ন কারণে বলেছে। সিরাজের বিরুদ্ধে এ ধরনের কথা শুনিনি। বরং সিরাজ আমাদের সবচেয়ে নির্যাতিতদের একজন। তাছাড়া যারা গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে, তাদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আর্থিক লেনদেনের বিনিময়ে ছাত্রদলের নতুন কমিটিতে বিবাহিত, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নিজস্ব বলয়ে রাজনীতি করেন বিবাহিত, অপহরণ ও বাইক ছিনতাই মামলার আসামিদেরও পদ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ প্রাধান্য পেয়েছেন বরিশাল, খুলনা-যশোর ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের নেতাকর্মীরা। ৩০২ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ৪৫ জনের বেশি আছেন বিবাহিত। ছাত্রজীবন শেষে অনেকেই চাকরি করছেন। অছাত্র, বিবাহিত, জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনসহ অসংখ্য অসামঞ্জস্য দিয়েই গঠিত হয়েছে ছাত্রদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ছাত্রদলের কমিটিতে স্থান পাওয়া এমন ৫৭ জনের একটি তালিকা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর (কারাগারে যাওয়ার আগে) বরাবর প্রেরণ করেছেন পদবঞ্চিত ত্যাগী নেতাকর্মীরা। সে সময় প্রাথমিকভাবে অভিযোগ আমলে নিয়ে ৩৩ জনের পদ সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে।
ঢাবি ক্যাম্পাসে নেই কার্যক্রম
জানা গেছে, ছাত্ররাজনীতির আঁতুরঘর হিসেবে খ্যাত ঢাবি ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের কার্যক্রম নেই। সংগঠনের বিগত কমিটির নেতারা ঢাবিতে রাজনীতির সহাবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হলেও পুরোপুরি ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে বর্তমান কমিটি। ঢাবি থেকে বিতাড়িত হওয়ার নেপথ্যে সাধারণ সম্পাদক জুয়েলের ভূমিকা রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাবেক নেতা আদনান আলম বাবু, তিনি সাইফ মাহমুদ জুয়েল গ্রুপের বড় ভাই। একই সঙ্গে তিনি ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়ের আপন মামাতো ভাই। তিনি একই সঙ্গে জয়কে দিয়ে ছাত্রলীগের বিভিন্ন কমিটিতে সুবিধা নিয়েছেন, তেমনি নিজ সংগঠনের এবং নিজ গ্রুপের ছোট ভাই জুয়েলের কাছে ছাত্রদলের তদবির করছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২২ সালের ২৪ মে ঢাবির টিএসসিতে মিছিল-পরবর্তী সভায় শেখ হাসিনাকে ‘তুমি’ সম্বোধন করে বক্তব্য দেন জুয়েল। তার আগের দিন আদনান বাবুর মধ্যস্থতায় ধানমন্ডি স্টার কাবাবের সামনে একটি কালো রঙের গাড়িতে বসে আল নাহিয়ান খান জয় ও সাইফ মাহমুদ জুয়েল আধা ঘণ্টার বেশি সময় আলাপ করেন। পরদিন ২৪ মে জুয়েল ক্যাম্পাসে বক্তব্য দেওয়ার পর প্রথমে জয়ের অনুসারীরাই ক্যাম্পাসে ছাত্রদলকে প্রতিহতের ঘোষণা দেয়। ওই ঘটনা যে জয়-জুয়েলের পরিকল্পিত তা আরও স্পষ্ট হয় যখন জুয়েল ক্যাম্পাসে নিজে হাতে বাঁশ নিয়ে ছাত্রলীগকে উসকে দেয়। যদিও কিছুক্ষণের জন্য বাঁশ হাতে নিয়ে জুয়েল সেদিন ঢাবি ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের বিপদে ফেলে চলে গিয়েছিলেন। শুধু জুয়েল ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করতে গিয়ে ছাত্রদল আজকে ক্যাম্পাস ছাড়া বলে ঢাবি ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের অভিযোগ।
এ প্রসঙ্গে জুয়েল বলেন, জয় নয়, ছাত্রলীগের কোনো নেতার সঙ্গে কোনো সামাজিক প্রোগ্রামে আমাদের কেউ দেখেছে এ কথা যদি বলতে পারে, আমি দায়িত্ব ছেড়ে যাবে। এসব কাল্পনিক কথা বলে কে? যেসব নেতাকর্মী সুনির্দিষ্টভাবে এ কথাগুলো বলেছে তাদের আমাকে বলতে বলেন। আমি ব্যবস্থা নেব।
কমিটি গঠনে অঞ্চলপ্রীতি
বিভিন্ন ইউনিট কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে ছাত্রদল সভাপতি শ্রাবণ তার নিজ এলাকা যশোর-খুলনা এবং গ্রুপিংয়ের এলাকা ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল ও সাধারণ সম্পাদক জুয়েল নিজ এলাকা বরিশাল অঞ্চলের ছেলেদের প্রাধান্য দিয়েছেন। যেমন কবি নজরুল কলেজ ছাত্রদলের ১৩ সদস্যবিশিষ্ট কমিটির ৮ জনই বরিশাল বিভাগের। এভাবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা মহানগর উত্তর, ঢাকা মহানগর পশ্চিম ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার কমিটি গঠনে নিজ এলাকার অনুসারীদের পদায়ন করেছেন। এ বিষয়ে জুয়েল বলেন, এটা মিথ্যা কথা। যারা অভিযোগ করেছে তাদের নিয়ে আসেন আমরা সাক্ষাতে কথা বলি। পদ দেওয়া হয়েছে যোগ্যতার ভিত্তিতে।
শীর্ষপদে আলোচনায় যারা
ছাত্রদলের নতুন কমিটির শীর্ষ পদের জন্য আলোচনায় আছেন ছাত্রদলের সিনিয়র সহসভাপতি রাশেদ ইকবাল খান, সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাকিবুল ইসলাম রাকিব, সাংগঠনিক সম্পাদক আবু আফসান মো. ইয়াহিয়া, সহসভাপতি মাহবুব মিয়া, নাছির উদ্দিন নাছির, আক্তারুজ্জামান আক্তার, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সোহেল রানা, সাফি ইসলাম, আমান উল্লাহ আমান, মঞ্জুরে আলম রিয়াদ, সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শ্যামল মালুম, ঢাবির মমিনুল ইসলাম জিসান অন্যতম।
জনতার আওয়াজ/আ আ
