কমিটি ভাঙাগড়া নিয়ে ঝড় বিএনপিতে
নিজস্ব প্রতিবেদক, জনতার আওয়াজ ডটকম
প্রকাশের তারিখ:
শনিবার, জুন ১৫, ২০২৪ ৩:১৬ অপরাহ্ণ পরিবর্তনের তারিখ:
শনিবার, জুন ১৫, ২০২৪ ৩:১৬ অপরাহ্ণ
জনতার আওয়াজ ডেস্ক
সরকারবিরোধী আন্দোলনে ব্যর্থতা নিয়ে বিএনপির ভেতর দীর্ঘদিন ধরে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। কেউ কেউ এ জন্য মাঠ পর্যায়ের নেতৃত্বকে দায়ী করছেন। তৃণমূলের নেতাকর্মীর অধিকাংশই মনে করেন, সঠিক দিকনির্দেশনা ও পরিকল্পনার অভাবে আন্দোলনে বারবার হোঁচট খাচ্ছে দল। নেতৃত্ব নিয়ে এমন সমালোচনার মধ্যেই আকস্মিক ঢাকাসহ দেশের চার মহানগর কমিটি এবং যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত করা হলো। এটি সরকার পতনের আন্দোলনে ব্যর্থতার ফল, নাকি এর পেছনে অন্য হিসাবনিকাশ রয়েছে; শুরু হয়েছে তার চুলচেরা বিশ্লেষণ।
দলটির গুরুত্বপূর্ণ এসব ইউনিটের কমিটি বিলুপ্তির ঘোষণা আসে গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে। এ নিয়ে সারাদেশে দলের মধ্যে শুরু হয় আলোচনা। কেউ কেউ এ ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেন। তৃণমূল পর্যায়ে অনেক নেতাকর্মী এতে খুশি। তবে বিলুপ্ত কমিটির নেতাদের কেউ কেউ ক্ষুব্ধ। অনেকে আবার এরই মধ্যে নেতৃত্বে আসতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। সব মিলিয়ে কমিটি ভাঙাগড়া নিয়ে বিএনপিতে বইছে ‘ঝড়’। নতুন কমিটিতে কারা আসতে পারেন, তা নিয়েও চলছে জল্পনা-কল্পনা।
বিএনপি নেতারা বলছেন, সরকারবিরোধী আন্দোলনে ব্যর্থ হওয়ার পর দল পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সেই প্রক্রিয়ায় মেয়াদোত্তীর্ণ, ব্যর্থ সব কমিটি ভেঙে দেওয়া হবে। গত ৭ জানুয়ারির ভোটের পর আন্দোলনে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের শীর্ষ নেতাদের ভূমিকা মূল্যায়ন শুরু করে দলটির হাইকমান্ড। এই পর্যালোচনা শেষে রাজপথের সক্রিয় নেতাদের দিয়ে দল ও অঙ্গসংগঠন পুনর্গঠনের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। এর অংশ হিসেবে গত বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপি, বরিশাল ও চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপি এবং যুবদলের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে বলা হয়, পরবর্তী সময়ে নতুন কমিটি করা হবে। তবে নতুন কমিটির ঘোষণা ঈদের আগে না পরে দেওয়া হবে, সে বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। অনেক নেতাকর্মী গতকাল দিনভর নতুন কমিটির অপেক্ষায় ছিলেন। তারা মনে করেন, যে কোনো সময় কমিটি ঘোষণা হতে পারে।
এর আগে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপি এবং যুবদলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে ভার্চুয়ালি পৃথক বৈঠক করেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এ সময় নতুন কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত জানিয়ে তারেক রহমান নেতাদের সহযোগিতা চান। বিএনপির চট্টগ্রাম ও বরিশাল মহানগর কমিটি গঠনের কথা আগেই জানিয়ে ছিলেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। এদিকে একই দিন মধ্যরাতে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ঢাকা মহানগর উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম ছাত্রদলের কমিটিও ভেঙে দেওয়া হয়।
দল পুনর্গঠনের এ প্রক্রিয়ায় খুশি তৃণমূল পর্যায়ের অনেক নেতাকর্মী। তারা মনে করছেন, সরকারবিরোধী আন্দোলনে এসব সাংগঠনিক ইউনিটের নেতারা রাস্তায় ছিলেন না। সংগঠিত করতে পারেননি কর্মীদের। কোনো দিকনির্দেশনাও দিতে পারেননি। অন্যদিকে ঈদুল আজহার তিন দিন আগে এসব কমিটি বিলুপ্ত করায় অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করেন, ক্ষুব্ধও হয়েছেন। এ ঘটনাকে তারা ঈদের আনন্দ ম্লান করে দেওয়ার ‘মধ্যরাতের ঝড়’ বলে বর্ণনা করছেন। বিশেষ করে যুবদলের মেয়াদ আরও আট মাস বাকি থাকতে কমিটি ভেঙে দেওয়ার ঘটনাকে ‘অস্বাভাবিক’ বলছেন কেউ কেউ। তারা মনে করেন, দলের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করতে একটি সিন্ডিকেট এসব কমিটি ভেঙে দেওয়ার পক্ষে কাজ করেছে। দীর্ঘদিন ধরে দলের ভেতর আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে তৎপরতা চালাচ্ছে তারা। অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনে পছন্দের নেতাদের দিয়ে নতুন কমিটি গঠনে চেষ্টা করছে প্রভাবশালী ওই বলয়।
সদ্য বিলুপ্ত ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আবদুস সালাম বলেন, কমিটি ভেঙে দেওয়া চলমান সাংগঠনিক প্রক্রিয়া। আমরা সর্বোচ্চ কাজ করার চেষ্টা করেছি। আগামীতে অবশ্যই ভালো নেতৃত্ব আসবে। নতুন কমিটিতে যারা আসবেন, তারা সংগঠনকে আরও বেশি গতিশীল এবং এগিয়ে নেওয়ার জন্য কাজ করবেন বলে প্রত্যাশা করি।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, দীর্ঘদিন ধরে কমিটিগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ। এ জন্য বিলুপ্ত করা হয়েছে। খুব শিগগির ত্যাগী ও যোগ্যদের নেতৃত্বে নতুন কমিটি ঘোষণা হবে। তবে কবে নাগাদ এসব কমিটি হবে, বিএনপির হাইকমান্ড সে সিদ্ধান্ত নেবেন।
তবে কেন্দ্রীয় যুবদলের কমিটির মেয়াদ এখনও শেষ হয়নি। ২০২২ সালের ২২ মে সুলতান সালাউদ্দিন টুকুকে সভাপতি ও মোনায়েম মুন্নাকে সাধারণ সম্পাদক করে ৮ সদস্যের আংশিক কমিটি দিয়েছিল বিএনপি। ৯ মাস পর ২০২৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি যুবদলের ২৫১ সদস্যের কেন্দ্রীয় পূর্ণাঙ্গ কমিটি দেওয়া হয়।
সুলতান সালাউদ্দিন টুকু বলেন, ‘কমিটি গঠন ও বিলুপ্ত চলমান সাংগঠনিক প্রক্রিয়া। বিএনপির হাইকমান্ড যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটা অবশ্যই ভালো। আর দল যখন যেখানে আমাকে দায়িত্ব দেবে, আমি সেই জায়গাতেই কাজ করব।’
এদিকে নতুন কমিটিতে পদ পেতে নেতাদের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ পদ পাওয়ার জন্য এরই মধ্যে অনেকে নানা মাধ্যমে তদবির করছেন। অঙ্গ সংগঠনগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ পদ পেতে দলের বিভিন্ন স্তরে যোগাযোগের পাশাপাশি নানাভাবে হাইকমান্ডের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে নেতারা চেষ্টা চালাচ্ছেন। শুক্রবার দুপুর থেকে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পদপ্রত্যাশী নেতারা কর্মীদের নিয়ে জড়ো হতে শুরু করেন।
এর আগে গত ১ মার্চ ছাত্রদলের কমিটিও এক মাসের মেয়াদ থাকা অবস্থায় হঠাৎ ভেঙে দিয়ে নতুন কমিটি গঠন করা হয়। এর আগের দিন রাতে ছাত্রদলের ‘সুপার ফাইভ’ নেতাদের সঙ্গে ভার্চুয়ালি কথা বলেন তারেক রহমান। পরে রাকিবুল ইসলাম রাকিবকে সভাপতি ও নাছির উদ্দীন নাছিরকে সাধারণ সম্পাদক করে সাত সদস্যের কমিটি ঘোষণা করা হয়। একইভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কমিটিও ঘোষণা করা হয় তখন। সংগঠনের পদপ্রত্যাশী নেতাদের আলোচনার কোনো সুযোগই দেওয়া হয়নি। বিগত আন্দোলনের মূল্যায়নের ভিত্তিতে ওই কমিটি গঠন করা হয় বলে দাবি করেন বিএনপি নেতারা।
ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপি
ঢাকা মহানগরের দুই কমিটি গঠন করা হয় ২০২১ সালের ২ সেপ্টেম্বর। আন্দোলনের ধারাবাহিক কর্মসূচিতে ঢাকা মহানগরে সক্ষমতার জানান দিলেও সর্বশেষ আড়াই মাসের চূড়ান্ত আন্দোলনে তার প্রতিফলন ছিল না। দুই কমিটির মধ্যে ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান, সদস্য সচিব আমিনুল হক, ঢাকা দক্ষিণের সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনু, ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব তানভীর আহমেদ রবীনসহ সংগঠনের সক্রিয় অনেককে কারান্তরীণ করার পর বেশির ভাগ নেতাই ছিলেন আত্মগোপনে।
বিএনপি কর্মীদের অভিযোগ, নির্বাচনের আগে শেষ আড়াই মাসের আন্দোলনে দুই কমিটির বেশির ভাগ দায়িত্বশীল নেতাকে কাছে পাননি। এমনকি ফোনেও পাওয়া যায়নি। মহানগর উত্তরের আমিনুল হককে গ্রেপ্তারের পর ওই এলাকায় আন্দোলনে ভাটা পড়ে। দক্ষিণের আহ্বায়ক আবদুস সালাম আন্দোলনের শুরু থেকেই ছিলেন আত্মগোপনে। বিগত কয়েক কমিটির মতো এই কমিটিও কাঙ্ক্ষিত আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারায় চরম ক্ষুব্ধ দলের হাইকমান্ড। এর অংশ হিসেবে মেয়াদোত্তীর্ণ এই কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। নতুন কমিটিতে মহানগর উত্তর বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব আমিনুল হক আহ্বায়ক এবং সাবেক যুবদল নেতা এস এম জাহাঙ্গীর সদস্য সচিব হতে পারেন। মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব রফিকুল ইসলাম মজনু নতুন কমিটির আহ্বায়ক এবং সদস্য সচিব পদে সংগঠনের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক তানভীর আহমেদ রবিন, লিটন মাহমুদ ও হাবিবুর রশীদ হাবিবের নাম শোনা যাচ্ছে।
এদিকে এসব সাংগঠনিক ইউনিটের বাইরে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটিসহ ঢাকা মহানগরের চার ইউনিট কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। যে কোনো সময় এসব কমিটি ঘোষণা করা হতে পারে। ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির বলেন, ঢাকা মহানগরে চার ইউনিটে নতুন কমিটি গঠনের জন্য যাচাই-বাছাই চলছে।