কেন বিচার বিভাগের জন‍্য স্বতন্ত্র সচিবালয় অত্যাবশ্যক? - জনতার আওয়াজ
  • আজ দুপুর ১২:৪৩, রবিবার, ১৬ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৩রা ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ই শাবান, ১৪৪৬ হিজরি
  • jonotarawaz24@gmail.com
  • ঢাকা, বাংলাদেশ

কেন বিচার বিভাগের জন‍্য স্বতন্ত্র সচিবালয় অত্যাবশ্যক?

নিজস্ব প্রতিবেদক, জনতার আওয়াজ ডটকম
প্রকাশের তারিখ: মঙ্গলবার, জানুয়ারি ২৮, ২০২৫ ২:০৬ অপরাহ্ণ পরিবর্তনের তারিখ: মঙ্গলবার, জানুয়ারি ২৮, ২০২৫ ২:০৬ অপরাহ্ণ

 

ব‍্যারিস্টার নাজির আহমদ

তিনটি বিভাগ নিয়ে অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মতো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র গঠিত। আর সেগুলো হলো: আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ। দুঃখজনক ও আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের জন্য স্ব স্ব সচিবালয় থাকলেও বিচার বিভাগের জন্য স্বতন্ত্র সচিবালয় নেই। বিদ‍্যমান পুরো সচিবালয় তো শাসন বিভাগ তথা নির্বাহী বিভাগের পারপাস সার্ভ করে। অপরদিকে আইন বিভাগের জন‍্য স্বতন্ত্র সচিবালয় থাকবে বলে খোদ সংবিধান স্পষ্ট করে বলেছে। সংবিধানের ৭৯(১) অনুচ্ছেদ বলেছে, ‘সংসদের নিজস্ব সচিবালয় থাকিবে’। কিন্তু বিচার বিভাগের জন‍্য কোনো স্বতন্ত্র সচিবালয় নেই। অতীতের কোনো সরকারই তা করেনি বা করতে দেয়নি।

বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ করা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ও আছে। নির্বাহী থেকে বিচার বিভাগ পৃথককরণ সংক্রান্ত ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আংশিক বাস্তবায়ন করা হয় ২০০৭ সালে। ওই বছর এক অধ্যাদেশ জারি করে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক করা হয়। কিন্তু বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ অদ্যাবধি নেওয়া হয়নি। সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদ স্পস্ট করে বলেছে, ‘রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হইতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন।’ সংবিধান ও ঐতিহাসিক মাসদার হোসেন মামলায় সর্বোচ্চ আদালতের দেয়া রায়ের আলোকে স্বতন্ত্র ও পৃথক বিভাগ হিসেবে গড়ে উঠতে বিচার বিভাগের জন্য আলাদা সচিবালয় অতি জরুরি। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও সর্বোপরি নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণ থেকে বিচার বিভাগকে রক্ষার জন্য বিচার বিভাগের আলাদা সচিবালয় প্রতিষ্ঠা সময়ের দাবি।

সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অধঃস্তন সকল আদালত ও ট্রাইব্যুনালের উপর তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা থাকবে হাইকোর্ট বিভাগের। ১০৯ অনুচ্ছেদ স্পষ্ট করে বলেছে, ‘হাইকোর্ট বিভাগের অধঃস্তন সকল [আদালত ও ট্রাইব্যুনালের] উপর উক্ত বিভাগের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা থাকিবে।’ সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদের মর্ম অনুযায়ী অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ হাইকোর্ট বিভাগের একচ্ছত্র অধিকার। সাংবিধানিক এই বাধ্যবাধকতা সুচারুরূপে সম্পন্ন করার জন্য পৃথক ও পূর্ণাঙ্গ (full fledged) বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠা অত্যাবশ্যক। তাই সংবিধানের ৭৯ অনুচ্ছেদে যেভাবে সংসদের নিজস্ব সচিবালয় থাকার কথা বলা হয়েছে ঠিক অনুরূপভাবে বিচার বিভাগের জন্য স্বতন্ত্র সচিবালয় নিশ্চিতের লক্ষ‍্যে পৃথক অনুচ্ছেদ সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত করা উচিৎ যাতে কোনো রাজনৈতিক সরকার এই বিষয়টিকে কোনোভাবেই অবজ্ঞা করতে না পারে।

বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের মামলার সংখ্যা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অধস্তন আদালতের বিচারকের সংখ্যা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রির কর্মপরিধি অতীতের তুলনায় ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই অবস্থা ও প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলেও বিচার বিভাগের জন্য পৃথক একটি সচিবালয় স্থাপন অত‍্যাবশ‍্যকীয় হয়ে পড়েছে। তাই সার্বিক বিশ্লেষণে কেবলমাত্র পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই অধস্তন আদালতের বিচারকগণের শৃঙ্খলা, বদলি, পদোন্নতি, ছুটি ও অন্যান্য বিষয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে মাসদার হোসেন মামলার আলোকে বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা ও পৃথকীকরণ নিশ্চিত করা সম্ভব। বিচার বিভাগের জন্য স্বতন্ত্র সচিবালয় না থাকার কারণে দীর্ঘদিন ধরে বিচার বিভাগে অনেকটা দ্বৈত শাসন চলে আসছে যা বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতার মূলে আঘাত হানে।

রাষ্ট্রের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী বিভাগ হলো নির্বাহী বিভাগ, কেননা তাদের হাতেই তো সব ক্ষমতা, প্রভাব ও প্রতিপত্তি। তাদের হাতেই যদি অন‍্য বিভাগ তথা বিচার বিভাগ তাদের কাজের জন্য মুখাপেক্ষী থাকেন তাহলে ঐ বিভাগ সুচারুভাবে ও স্বাধীনভাবে তাদের কাজ করতে পারবে না। বারবার হোঁচট খাবে। এমনটিই তো জাতি বারবার দেখেছে বিগত ৫৩ বছরে।

এমনিতেই সরকারি অফিসগুলো আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় জর্জরিত। ফাইল সহজে টেবিল থেকে নড়ে না। প্রশাসনের বিভিন্ন স্টেজে তদবির করা যেন সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অযথা তিনটি দস্তখতের জায়গায় ৮/৯টি টেবিলে যাওয়া ও দস্তখত আনার নিয়ম করে জনভোগান্তির সৃষ্টি করা হয়। সচিবালয়, রাজউক অফিস ও অন‍্যান‍্য সরকারি অফিসের ভুক্তভোগীরা এ কথার সত‍্যতা নিশ্চিত করতে পারবেন। এমন আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় জর্জরিত নির্বাহী বিভাগের উপর বিচার বিভাগকে মুখাপেক্ষী করে রাখার যৌক্তিকতা কতটুকু?

বৃটেনে বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ। সেখানে বিচার বিভাগের জন‍্য আছে স্বতন্ত্র সচিবালয়। সুবিচার নিশ্চিত করতে, বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালন করতে এবং সাচিবিক সাপোর্টের জন্য কোনোভাবেই নির্বাহী বিভাগের উপর নির্ভর করতে হয় না। বরং যে কোনো বিষয়ে বিচার বিভাগের হুকুম ও আদেশ তামিল করতে নির্বাহী বিভাগ সদা উদগ্রীব থাকেন। নির্বাহী বিভাগ বৃটেনে বিচার বিভাগকে বাঘের মতো ভয় পায়। সত‍্যিকার অর্থে যে দেশে আদালত ও আদালতের আদেশকে নির্বাহী বিভাগ বাঘের মতো ভয় না করে ততক্ষণ পর্যন্ত সে দেশে আইনের শাসন পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা লাভ করে না।

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়েই স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করার মুখ‍্য সময়। কেননা তাদের তো কোনো পলিটিক্যাল ব‍্যাগেজ নেই। তাদেরকে কোনো রাজনৈতিক দল বা দলসমূহকে খুশি করতে হবে না। মাননীয় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ গত বছরের ২৭শে অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট থেকে পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় গঠন সংক্রান্ত প্রস্তাব আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেন। তিনি ২৫তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কার্যকর ভূমিকা নেন। তাঁর পাঠানো প্রস্তাবে সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদ এর উদ্দেশ্য পূরণকল্পে হাইকোর্ট বিভাগ, অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ যথাযথরূপে পালনের উদ্দেশ্যে একটি স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি অধ্যাদেশের খসড়া, প্রস্তাবিত সচিবালয়ের অর্গানোগ্রাম এবং সম্ভাব্য সংস্কার সম্পর্কে প্রস্তাব প্রেরণ করা হয়।

রাজনৈতিক সরকারগুলো গত ৫৩ বছরে যা পারে নাই বা করে নাই তা করে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জাতিকে দেখিয়ে দিতে পারেন। বিচার বিভাগের জন‍্য স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠা হবে আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে এক মাইলফলক।

লেখক: বিশিষ্ট আইনজীবী, রাষ্ট্রচিন্তক, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ইংল্যান্ডের প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার।Email: ahmedlaw2002@yahoo.co.uk

Print Friendly, PDF & Email
 
 
জনতার আওয়াজ/আ আ
 

জনপ্রিয় সংবাদ

 

সর্বোচ্চ পঠিত সংবাদ