খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
নিজস্ব প্রতিবেদক, জনতার আওয়াজ ডটকম
প্রকাশের তারিখ:
বুধবার, মার্চ ১৬, ২০২২ ১:২৭ অপরাহ্ণ পরিবর্তনের তারিখ:
বুধবার, মার্চ ১৬, ২০২২ ১:২৭ অপরাহ্ণ

বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, ভাষা সৈনিক, জাতীয় নেতা, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও বিএনপির সাবেক মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর উপজেলার খিরাই পাচুরিয়া গ্রামে ১৯৩৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা খোন্দকার আবদুল হামিদ ছিলেন একজন মশহুর আলেম এবং তাঁর মাতা আকতারা খাতুন ছিলেন একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিত্ব।
খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন ১৯৪৭ সালে মানিকগঞ্জ হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা এবং ১৯৪৯ সালে মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫২ সালে অর্থনীতিতে বিএ (অনার্স), ১৯৫৩ সালে এমএ এবং ১৯৫৫ সালে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নকালে খোন্দকার দেলোয়ার বাহান্নর ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থীর সপক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেন।
খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন সিলেট মুরারী চাঁদ কলেজে অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। পরে তিনি মানিকগঞ্জ মহকুমা আদালতে আইন পেশায় নিয়োজিত হন।
খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন ১৯৫৭ সালে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগ দেন এবং তখন থেকেই তাঁর সক্রিয় রাজনৈতিক জীবনের শুরু। ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সম্মিলিত বিরোধীদলের (কপ) প্রাথী ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে মানিকগঞ্জ মহকুমায় গঠিত ইলেকশন মনিটরিং কমিটির প্রধান ছিলেন খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন। ১৯৬৫ সালে তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পাটির মানিকগঞ্জ মহকুমা শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। আইনজীবী সমিতিগুলোর কোর্ডিনেশন কাউন্সিলের নির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে তিনি ১৯৬৬ সালে ছয়দফা কর্মসূচি আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব বিরোধী গণআন্দোলনে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ছিল। তিনি ১৯৭০ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পাটির মনোনীত প্রার্থী হিসেবে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন ছিলেন ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক এবং তিনি মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাক বাহিনীর গণহত্যা শুরুর পরপরই মানিকগঞ্জে গঠিত বিপ্লবী কম্যান্ড কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন খোন্দকার দেলোয়ার।
১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি প্রতিষ্ঠার পর খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন দলের মানিকগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮৯ সালে পুনরায় তিনি বিএনপির মানিকগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮৫ সাল থেকে তিনি ছিলেন বিএনপির জাতীয় স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য।
খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি’র মনোনীত প্রার্থী হিসেবে মানিকগঞ্জ-১, ঘিওর-দৌলতপুর, নির্বাচনী এলাকা থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি বিএনপির মনোনীত প্রার্থী হিসেবে মানিকগঞ্জ-১ নির্বাচনী এলাকা থেকে পঞ্চম (১৯৯১), ষষ্ঠ (১৯৯৬), সপ্তম (১৯৯৬) ও অষ্টম (২০০১) সংসদে সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি পঞ্চম, ষষ্ঠ ও অষ্টম জাতীয় সংসদে ক্ষমতাসীন সংসদীয় দলের চীফ হুইপ এবং সপ্তম জাতীয় সংসদে বিরোধী সংসদীয় দলের চীফ হুইপ ছিলেন। তিনি দুই মেয়াদে পার্লামেন্ট মেম্বার্স ক্লাবের সভাপতি এবং বিভিন্ন সংসদীয় কমিটির সভাপতি ও সদস্য ছিলেন। খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন বেশসংখ্যক সামাজিক সাংস্কৃতিক ও জনকল্যাণমূলক সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তিনি ১৯৭৬-১৯৭৮ এবং ১৯৮৪-১৯৮৫ সালে মানিকগঞ্জ আইনজীবী সমিতির সভাপতি এবং ১৯৭৯-১৯৮১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটের সদস্য ছিলেন। তিনি ১৯৭৯ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ কোঅপারেটিভ ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি ছিলেন মানিকগঞ্জ খোন্দকার নূরুল হোসেন ল’একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা ও অধ্যক্ষ। তিনি তাঁর নিজ গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন কলেজ এবং পাচুড়িয়া মাদ্রাসা। ঘিওর ও দৌলতপুর উপজেলার সার্বিক উন্নয়নে তাঁর ব্যাপক অবদান রয়েছে।
আশির দশকের শেষদিকে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের স্বৈরাচারী শাসন বিরোধী আন্দোলনে খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। বিএনপি নেতৃত্বাধীন সাত দলীয় মোর্চার লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। তত্বাবধায়ক সরকার কৃর্তক ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরি অবস্থা জারীর পর বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াও সেপ্টেম্বর গ্রেফতার হন। গ্রেফতার হওয়ার প্রাক্কালে তিনি দলের মহাসচিব আব্দল মান্নান ভূইয়াকে বহিস্কার করে তদস্থলে স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে দলের মহাসচিব পদে নিয়োগ দান করেন। এক-এগারোর পর যখন বেগম খালেদা জিয়াসহ দলের সিনিয়র নেতৃবর্গ আটক ছিলেন, খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন তখন অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে সঙ্কটের মোকাবেলা করে দলের ঐক্য ও অখণ্ডতা অক্ষুন্ন রাখেন। ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত দলের পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলের পর পুনরায় তিনি বিএনপির মহাসচিব নিযুক্ত হন।
খোন্দকার দেলোয়ার স্মরণীয় হয়ে থাকবেন জাতীয় স্বার্থে পালিত তাঁর সংগ্রামী ভূমিকার জন্য। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে ক্ষমতা দখলকারী এক এগারোর সরকারের দিনগুলোতে তাঁর ভূমিকার কথা স্মরণ করলে দেখা যাবে, গণতন্ত্র পুনরুদ্বারের সংগ্রামে তিনি ছিলেন আপসহীন এক দুর্দান্ত সাহসী নেতা।
খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন মনে-প্রাণে গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন। নিজে বিএনপি করলেও অন্য দলগুলোর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাবোধ ছিল। ছিল পরমতসহিষ্ণুতা। প্রতিপক্ষের কঠোর সমালোচনা করতেন তিনি, কিন্তু বিদ্বেষ বা শত্রুতা নয়, সবকিছুর পেছনে থাকত কেবলই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে কখনও একচুল পরিমাণ ছাড় দেননি তিনি। নিখাদ ছিল তাঁর দেশপ্রেম।
ভাষা আন্দোলনে তাঁর সক্রিয় ভূমিকার জন্য খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন একুশে পদকে ভূষিত হন।
সিঙ্গাপুরে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় ২০১১ সালের ১৬ই মার্চ তাঁর মৃত্যু হয়।
তথ্যসূত্র
খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন স্মৃতি ফাউন্ডেশন
জনতার আওয়াজ/আ আ
