গত কয়েক মাসে হল ছেড়েছে প্রায় ৩০ জনের মতো শিক্ষার্থী
নিজস্ব প্রতিবেদক, জনতার আওয়াজ ডটকম
প্রকাশের তারিখ:
শনিবার, মার্চ ১২, ২০২২ ৬:২৩ অপরাহ্ণ পরিবর্তনের তারিখ:
শনিবার, মার্চ ১২, ২০২২ ৬:২৩ অপরাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে গেস্টরুমের ‘মিনি আদালতে’ প্রতি রাতেই বসে কথিত বিচার। হয় নির্যাতন। এখানে দু’টি পক্ষ। এক পক্ষ যারা ছাত্র সংগঠনের নামে বিচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। কখনো
ধোঁয়া না ছেড়ে ধূমপান, দলীয় অনুষ্ঠানে না যাওয়ায় ঘুম থেকে তুলে এনে রাতভর নির্যাতনসহ অনেক ঘটনার সাক্ষী এই মিনি আদালত। আর এই আদালতের আসামি হচ্ছেন নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থীরা। এই অমানবিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে গত কয়েক মাসে হল ছেড়েছে প্রায় ৩০ জনের মতো শিক্ষার্থী। এমনটিই জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট সূত্র।
সম্প্রতি গভীর রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে ২০১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থী আবু তালিবকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে একই হলের ২০১৮-১৯ সেশনের চারজন ছাত্রলীগ কর্মীর বিরুদ্ধে।
ওই আবাসিক হলের ২০১ (ক)নং কক্ষে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনাটি ঘটে। এই নির্যাতন ঘটনার পরপরই হল ত্যাগের ঘোষণা দিয়ে আত্মগোপনে চলে যান এই শিক্ষার্থী। প্রথমে ঢাকার বাইরে চলে গেলেও বর্তমানে এক বন্ধুর আশ্রয়ে আছেন এই শিক্ষার্থী। অপরিচিত কোনো ফোন নম্বরই রিসিভ করছেন না তিনি। জীবন আশঙ্কা ও ভয়ের মধ্যে দিয়ে দিন পার করছেন। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় মানবজমিনের সঙ্গে কথা হয় তার। নির্যাতনের বিষয়ে জানতে নির্যাতনের শিকার আরও একাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয়। তাদের বর্ণনায় উঠে এসেছে গেস্টরুমের আদালতে নির্যাতনের করুণ বর্ণনা।
আবু তালিব বলেন, এই ঘটনার পরপরই ভয়ে ঢাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছিলাম। পরবর্তীতে এক বন্ধুর বাসায় উঠি। বর্তমানে পুরোপুরি আত্মগোপনে আছি বলা চলে। অপরিচিত কোনো মুঠোফোন থেকে ফোন এলে রিসিভ করছি না। কারণ, কোথা থেকে কখন কি হুমকি আসে জানি না। আমার বাবা একজন হার্টের রোগী। মানিকগঞ্জে থাকেন। বাবা-মা দু’জনেরই বয়স হয়েছে। ভাই-বোনদের মধ্যে ছোট হওয়ায় আমাকে নিয়ে তারা এমনিতেই দুশ্চিন্তায় থাকেন। সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি পুরো বিষয়টি এখন পর্যন্ত আমার পরিবারকে না জানাতে। বাবা যেহেতু অসুস্থ তাই আমাকে নির্যাতনের বিষয়টি জানলে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। এই শিক্ষার্থী বলেন, আমাকে নির্যাতনের বিষয়টি নতুন নয়। এর আগেও আমার শরীর নিয়ে বিভিন্নভাবে বুলিং করা হয়েছে। আমি শুকনো। চোখ দেখতে খারাপ। মুখ দেখলে মনে হয় মাদকাসক্ত।
এরকম বুলিং প্রায় নিয়মিতই চলতো আমার সঙ্গে। হল ছেড়ে আসার পর গতকাল নির্যাতনে অংশ নেয়াদের মধ্যে থেকে একজন আমাকে ফোন করে বলে, ক্যাম্পাসে আয়, কাজ আছে। আমি তো এখন আরও ভয়ের মধ্যে আছি। বিভিন্নভাবে হুমকি আসতে পারে। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভোস্ট বরাবর লিখিত আবেদন করার পর আমাকে দেখা করতে বলা হয়েছে। কিন্তু ভয়ে স্যারদের সঙ্গে দেখা করতে যেতে পারছি না। যেকোনো সময় আমার ওপর বড় কোনো হামলা হতে পারে। তবে এভাবে কতদিন আত্মগোপনে থাকতে পারবো জানি না। আত্মগোপনে থেকে পড়ালেখা কীভাবে নিয়মিত করবো সেটা নিয়েও দুশ্চিন্তায় আছি।
তালিব বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি বিদ্যাপীঠ থেকে একজন শিক্ষার্থী কখন হল ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয় সেটা শুধুমাত্র নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থীই জানেন। আমরা যারা হল ছেড়েছি তাদের হলে দ্বিতীয়বার ওঠা খুবই বিপজ্জনক। যেকোনো সময় বড় ধরনের কোনো নির্যাতন হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় বরাবর লিখিত অভিযোগ জানালেও হলের ভেতরে আমার নিরাপত্তা কে দেবেন? তিনি বলেন, আমরা এখানে এসেছি পড়ালেখা করতে। প্রতিদিন যদি দলীয় মিছিল মিটিং, কর্মসূচিতে তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় নষ্ট করি পড়ালেখা করবো কখন। আক্ষেপ করে এই শিক্ষার্থী বলেন, এই চার ঘণ্টা যদি পড়ালেখার কাজে প্রতিটি শিক্ষার্থী ব্যয় করতে পারতো তাহলে দেশ কোথায় এগিয়ে যাবে আমরা চিন্তা করতে পারবো না।
সূর্যসেন হলের গেস্টরুমে নির্যাতনের শিকার আরেকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেন। তাকেও এক দফা হল ছাড়তে হয়েছিল। নিজের পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, মোবাইলের চার্জার দেয়াকে কেন্দ্র করে আমাকে মারধর করা হয়। ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী সিফাত উল্লাহ সিফাত মারধর করেন। এই শিক্ষার্থী বলেন, কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাথরুম থেকে বেরিয়ে আমাকে এলোপাতাড়ি মারতে থাকে সিফাত।
এ সময় আমার বাবা-মাকে খুব বাজে ভাষায় গালিগালাজ করছিল। পরীক্ষার আগে একটি রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে যেতে বললে না যাওয়ার কারণে এভাবে মারধর করে। পরীক্ষা চলাকালীন আমাকে হল থেকে মেরে বের করে দেয় সিফাত উল্লাহ। এই শিক্ষার্থী বলেন, জিয়া হলের এক ছোট ভাই একইভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। প্রতিদিনই এই শিক্ষার্থী হল ছাড়তে চাইলেও শুধুমাত্র ক্যারিয়ারের বিষয়টি চিন্তা করে নির্যাতন সহ্য করে হলে পড়ে আছেন। এই সহ্যের বাঁধ কতদিন স্থায়ী হবে এটা কেবল সেই ভালো বলতে পারবেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেন, আবাসন সংকটের কারণে ছাত্র রাজনীতিতে অনেক নেতিবাচক উপাদান প্রবেশ করেছে। এটা ঠিক। আর আবাসন সংকট তো ছাত্র সংগঠন তৈরি করেনি। এটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়। আবাসন সংকটের যদি স্থায়ী সমাধান হয় তাহলে এ ধরনের নেতিবাচক ঘটনা কমে আসবে বলে মনে করি। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল প্রশাসনকে আরও উদ্যোগী হতে হবে। যেকোনো শিক্ষার্থীর সঙ্গে যদি মানহানিকর, নেতিবাচক ঘটনা ঘটে তাহলে হল প্রশাসনকে উদ্যোগী হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যমান আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
এদিকে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী বলেন, বঙ্গবন্ধু হলের ঘটনাটির বিষয়ে হল প্রভোস্টকে জানানো হয়েছে। এ বিষয়গুলো সম্পর্কে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি বলেন, আমার জানা মতে যেখান থেকে অভিযোগগুলো তৈরি হয় অর্থাৎ হল কেন্দ্রিক একাধিক ঘটনার শাস্তি হয়েছে।
অভিযোগের বিষয়গুলো আমরা দেখছি। আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ করা এবং তথ্য-প্রমাণ দিয়ে সহযোগিতা করলে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে সুবিধা হয়। ৩০ জন শিক্ষার্থীর হল ছাড়া প্রসঙ্গে প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী- এই সংখ্যাটি মনে হয় সঠিক নয়। একটি সংগঠন ১৮টির মতো অভিযোগ করেছে। তিনি বলেন, কয়েক বছরের মধ্যে এটা রেকর্ডসংখ্যক কম। আমরা এটাকে শূন্যের কোঠায় আনার জন্য মানসিকতা পোষণ করি। ইতিমধ্যে আমরা কাজ শুরু করেছি। এবং সার্বিক সহযোগিতা পেলে আমি মনে করি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এগুলো বন্ধ হওয়া উচিত। তিনি বলেন, একজন শিক্ষার্থী তার মায়ের কাছে গিয়েছে জানি। আমাদের সর্বশেষ প্রভোস্ট কমিটিতে প্রতিটি গেস্টরুমে সিসিটিভি ক্যামেরা সংযোজন করতে বলা হয়েছে। সব কিছুই কমে আসবে। একদম বন্ধ হতে সময় লাগবে।