তহবিল আত্মসাৎ করে আন্দোলন হয় কীভাবে?
নিজস্ব প্রতিবেদক, জনতার আওয়াজ ডটকম
প্রকাশের তারিখ:
রবিবার, মে ১২, ২০২৪ ৮:২৮ অপরাহ্ণ পরিবর্তনের তারিখ:
রবিবার, মে ১২, ২০২৪ ৮:২৮ অপরাহ্ণ

মো. সাখাওয়াত হোসেন
কারো পৌষ মাস কারো সর্বনাশের মতোই অবস্থা বিএনপি নেতাকর্মীদের। কেউ আন্দোলনে জীবনবাজি রেখে লড়াই করেছেন, আর কেউ নিজের আখের গুছিয়েছেন। অনেকেই আন্দোলনের লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। অন্যদিকে, তৃণমূল কর্মীরা রাজনৈতিকভাবে হতাশায় থেকে জীবনযাপন করছেন। খবরে জানা যায়, গত বছরের অক্টোবর থেকে শুরু হয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন পর্যন্ত বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলন পরিচালনা, নেতাকর্মীর দেখভাল করা, বিভিন্নভাবে নির্যাতিত নেতাকর্মীর পাশে থাকার জন্য দলের তহবিল থেকে দায়িত্বশীল নেতাদের অর্থ দেওয়া হয়। এর বাইরে আন্দোলনের নাম করে ধনাঢ্য নেতা কিংবা শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছ থেকেও চাঁদা সংগ্রহ করেন অনেকে। সব মিলিয়ে বড় ধরনের আর্থিক তহবিল গঠন হলেও নেতাকর্মীরা ছিটেফোঁটাও পাননি। এ কারণে অনেক এলাকায় আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। উপরন্তু নেতাকর্মীদের মধ্যে বিরোধ, বিভাজন ক্রমশ স্পষ্ট হয়েছে।
দলের দায়িত্বশীল একজন নেতা সংবাদমাধ্যমকে জানান, ভয়াবহ আর্থিক অনিয়ম হয়েছে রাজশাহী, বরিশাল, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ বিভাগ ও সিলেট জেলায়। সবচেয়ে বেশি অর্থ লোপাটের ঘটনা ঘটেছে রাজশাহী বিভাগে। জানা যায়, দলের পক্ষ থেকে যে অর্থ দেওয়া হয়েছিল, তার বাইরেও নেতারা চাঁদা সংগ্রহ করেছেন। তবে দল থেকে যে সহায়তা করা হয়েছে, তাও নেতাকর্মীর মধ্যে বণ্টন না করে নিজেদের পকেট ভারী করেছেন অনেকেই। দলের কাছে তারা নামকাওয়াস্তে হিসাব জমা দিলেও তাতে অনেক গরমিল রয়েছে।
আন্দোলনকালীন আয়-ব্যয়ের হিসাব জমা দিয়েছে সিলেট জেলা বিএনপি। প্রদত্ত হিসাব থেকে জানা যায়; ৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকা আয় এবং ২৫ লাখ ৫ হাজার টাকার খরচ দেখানো হয়েছে। হিসাব জমা দিয়ে বলা হয়েছে, অতিরিক্ত টাকা নিজেরা বহন করেছেন। এর প্রেক্ষিতে একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেছেন, তিনি নিজে ৬০ লাখ টাকা দিয়েছেন জেলা বিএনপিকে। সেখান থেকে ৩০ লাখ টাকা ফেরত দেওয়া হয় আন্দোলনের পর। অভিযোগ উঠেছে, আন্দোলনকালীন স্থানীয় নেতাদের ভূমিকা নিয়ে সিলেট জেলা বিএনপির প্রতিবেদনে নিজেদের বলয়ের নেতাকর্মীকে উপস্থাপন করা হয়েছে ইতিবাচকভাবে, আর অন্যদের তথ্য দেওয়া হয়েছে নেতিবাচকভাবে।
বরিশাল মহানগর বিএনপির কয়েকজন নেতা জানান, ওই অঞ্চলের আন্দোলনের সমন্বয়ক আড়াই মাসের টানা আন্দোলনে মাঠে ছিলেন না। নেতাকর্মীর খোঁজ রাখেননি দায়িত্বশীল নেতা। আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে কোনো ভূমিকা ছিল না তার। এমনকি গত বছরের ১৮ ও ২৮ অক্টোবর ঢাকায় সমাবেশ ও মহাসমাবেশের জন্য দেওয়া দলীয় তহবিলের টাকাও তছরুপ করা হয়েছে বলে অনুসন্ধানে উঠে আসে। আসা-যাওয়া, খাওয়াসহ অন্যান্য কার্যক্রমে নেতাকর্মীরা দলের পক্ষ থেকে কোনো সহায়তা পাননি। দলের একজন স্থায়ী কমিটির সদস্য জানান, আন্দোলনকালীন প্রতিটি বিভাগে পৃথক সমন্বয়ক ছিলেন। ওই সময়ে নেতাকর্মীর পাশে দাঁড়ানোর জন্য দল
থেকে বিভাগকে প্রয়োজন অনুযায়ী সাহায্যও করা হয়। প্রতিটি বিভাগে দল থেকে অর্ধকোটি টাকার বেশি সহায়তা দেওয়া হয় তখন।
এ ছাড়া ধনাঢ্য নেতা কিংবা শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছ থেকেও অনুদান নেওয়া হয়। সে ক্ষেত্রে কোথা থেকে কত টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে, তার প্রকৃত চিত্র দলের কাছে নেই। এটি অনিয়মের একটি বড় ধরনের নিয়ামক। বরিশাল বিভাগে আন্দোলন পরিচালনার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদককে। সেখানে ব্যাপক অনিয়ম ও টাকার হিসাবের গরমিল রয়েছে। শুধু আন্দোলনকালীন আর্থিক কেলেঙ্কারিই নয়, এই বিভাগে সাংগঠনিক সক্ষমতাকেও দুর্বল করে তোলা হয়েছে বিগত দিনে। সেখানেও আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা রয়েছে। স্থানীয়ভাবে যেসব নেতা সাধারণ মানুষের কাছে সম্মানিত, তাদেরই বেছে বেছে বাদ দেওয়া হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে বরিশাল বিভাগের আন্দোলনে। দীর্ঘদিন দলের সঙ্গে জড়িত কর্মী সমর্থকগণ কেউই রাজপথে নামেননি। দলীয় নেতাকর্মীরা যদি আন্দোলনে সাড়া প্রদান না করে তাহলে আন্দোলনে কিভাবে জমে উঠবে? দলের অন্তকোন্দলের কারণেই মূলত বিএনপি সঠিকভাবে তথা দলীয়ভাবে দাঁড়াতে বারবার ব্যর্থ হয়েছে।
বরিশাল বিভাগের চেয়েও ভয়াবহ অবস্থা চট্টগ্রাম বিভাগে। আন্দোলন চলাকালে দলের আর্থিক সহায়তার বাইরেও বিভাগের অনেক ধনাঢ্য নেতা ও ব্যবসায়ীর কাছ থেকে সুবিধা নেওয়া হয়েছে। তবে এর ছিটেফোঁটাও ভাগ্যে জোটেনি তৃণমূল নেতাকর্মীর। বিভিন্ন ভাবে বিপর্যাস্ত কিংবা আহত কর্মীদের পাশে দাঁড়াননি দায়িত্বশীল নেতারা। এমনকি জেলা পর্যায়েও কোনো সহায়তা করা হয়নি বলে জানান বিভিন্ন জেলার নেতাকর্মীরা। প্রতিটি সাংগঠনিক জেলা ও বিভাগে একই চিত্রের কথা উঠে এসেছে। বলা চলে, দলীয় শৃঙ্খলা ব্যতীত কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন আলোর মুখ দেখতে পারে না এবং বিএনপির আন্দোলন জমে না উঠার জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পাশাপাশি কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করেও আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছেন কয়েকটি বিভাগের সাংগঠনিক নেতারা। বিভিন্ন কমিটি গঠনে অনিয়মের জন্য একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও সেসব তদন্ত আর আলোর মুখ দেখেনি। কাজেই দলটি যেখানে সাংগঠনিকভাবে দাঁড়াতে ব্যর্থ হচ্ছে; সে জায়গায় আন্দোলনে গতি নিয়ে আসা দলটির পক্ষে প্রায় অসম্ভব। দীর্ঘদিন ধরে দলটি ক্ষমতার বাইরে, এই অবস্থায় দলটি নিজেদের মধ্যে একটি আস্থার জায়গা তৈরি করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ব্যক্তি বলয় তৈরি করবার মানসে যারা দলের নেতৃত্ব নির্ধারণ করে থাকেন তাদের দ্বারা কোনো রাজনৈতিক দলের কোনোরূপ মঙ্গল সাধিত হয় না। রাজনৈতিক দল পরিচালনায় দলীয় শীর্ষ নেতৃবৃন্দ ও তৃণমূলের কর্মীরাও চাঁদা সংগ্রহ করে দল পরিচালনা করে থাকেন। কিন্তু দলীয় তহবিল যদি যাচ্ছেতাইভাবে ব্যবহার করা হয় কিংবা তহবিল থেকে লুট করে অর্থ আত্নসাৎ করা হয় তাহলে তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্য কার্যতভাবে ব্যাহত হয়ে থাকে।
বিএনপি বিভিন্ন সময়ে আন্দোলনের ঘোষণা দিয়ে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে থাকে কিন্তু অর্থ খরচের জন্য যাদেরকে দায়িত্ব প্রদান করা হয় তারা অর্থকে বিভিন্ন উপায়ে তছরুপ করে আন্দোলনকে নিজেরাই বাঁধাগ্রস্থ করে তোলে। অর্থ তছরুপের ব্যাপারটি যেহেতু দলের অভ্যন্তরীণ বিষয় তাই বিষয়টি সহজে বাইরে বের হয়ে আসেনি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে সেহেতু বিএনপির আন্দোলন কেন জমে উঠেনি মর্মে আলোচনার রেশ ধরেই অর্থ সরিয়ে ফেলার প্রসঙ্গটি সামনে এসেছে। কাজেই বিএনপির অভ্যন্তরীন ব্যর্থতার ও দুর্নীতির কারণে বিএনপির আন্দোলন রাজনৈতিক বিবেচনায় একটি সাংগঠনিক কাঠামোয় পৌঁছতে বারবার ব্যর্থ হয়েছে। বিএনপির উচিত হবে কাউন্সিলের মাধ্যমে মূল নেতৃত্ব নির্বাচন করে শৃঙ্খলা অনুযায়ী দল পরিচালনা করা।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
shakhawat.cps@gmail.com
জনতার আওয়াজ/আ আ
