ধরো অস্ত্র করো রণ
নিজস্ব প্রতিবেদক, জনতার আওয়াজ ডটকম
প্রকাশের তারিখ:
মঙ্গলবার, মার্চ ৮, ২০২২ ৬:১৯ অপরাহ্ণ পরিবর্তনের তারিখ:
মঙ্গলবার, মার্চ ৮, ২০২২ ৬:১৯ অপরাহ্ণ
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
এই সময়ে তরুণরা বা যুবকরা কেউ আর যাত্রা দেখেন না। আসলে যাত্রার কালচারটি উঠেই গেছে। কিন্তু আমাদের ছেলেবেলা যাত্রা একটি নিয়মিত ব্যাপার ছিল। প্রধানত শীতকালে শস্য উঠে গেলে গ্রামে গ্রামে যাত্রার আয়োজন হতো। তার মধ্যে প্রধান ছিল রূপবান যাত্রা। এটাকে ভেঙেচুরে আরো নতুন নতুন যাত্রা হয়েছিল। যেমন বনবাসে রূপবান, সোহরাব রুস্তম, গুনাই বিবির পালা। তখন একেকটি দল একেকটি যাত্রার কারণে বিখ্যাত হয়েছিল। আমি যে ডায়ালগ দিয়ে শুরু করেছি সেটি ছিল রূপবান যাত্রার। রূপবান যাত্রার নায়কের নাম ছিল রহিম বাদশাহ। রূপবানের বয়স যখন ১২, তখন ভাগ্যের ফেরে তাকে বনবাসে যেতে হয়। সাথে রহিম বাদশাহ। বনবাসে যাওয়ার আগে শিশু রহিম বাদশাহর সাথে ১২ বছরের রূপবানের বিয়ে দেয়া হয়। তারপর রহিম বাদশাহকে নিয়ে রূপবান বনবাসে চলে যায়। রহিম বাদশাহ আস্তে আস্তে বড় হন এবং যুদ্ধবিদ্যায় যথেষ্ট পারদর্শিতা অর্জন করে। বনবাসে থাকা অবস্থায় রহিম বাদশাহর প্রেমে পড়ে যায় তাজেল নামে এক মন্ত্রিকন্যা। তাজেলের জেদ তার ‘রহিম বাদশাহকে চাই’। অথচ রূপবান ১২ বছর থেকে রহিম বাদশাহকে লালন-পালন করেছে; তাকে যুদ্ধবিদ্যা শিখিয়েছে এবং ভালোবেসেছে। রহিম বাদশাহকে রূপবান স্বামী হিসেবে জেনেছে। কিন্তু তাজেল এটা মানতে নারাজ। সে তার পিতার সাথে জেদ ধরল, রহিম বাদশাহর সাথে তাকে বিয়ে দিতে হবে। রহিম তো তাজেলকে বিয়ে করবে না। সে ততদিনে জেনে গেছে রূপবানই প্রকৃতপক্ষে তার স্ত্রী। কিন্তু মেয়ের আশা পূর্ণ করতে বদ্ধপরিকর তাজেলের বাবা। শেষে ঠিক হলো, তাজেলের বাবা এবং রহিম বাদশাহ যুদ্ধ করবে। তাদের মধ্যে যে জয়ী হবে প্রতিপক্ষকে তার কথা মেনে নিতে হবে। তাজেলের বাবা রহিম বাদশাহকে এই বলে যুদ্ধে আহ্বান জানালেন যে, ‘ধরো অস্ত্র করো রণ’।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে র্যাব এবং এর বর্তমান ও সাবেক সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে যে নর্তন কুর্দন করা হলো তাতে মনে হয়েছিল বাংলাদেশের হাত থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বুঝি রেহাই নেই। বাংলাদেশের মন্ত্রীরা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এমন সব ভাষায় কথা বলতে থাকেন যেন মনে হলো, যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসনের ‘খবর আছে’। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন এমনও বললেন যে, যুক্তরাষ্ট্র যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সে পাল্টা ব্যবস্থাটা কী সেটি তিনি স্পষ্ট করেননি। তবে বোঝা যায় যে, বাংলাদেশ চাইলে আমেরিকান কোনো সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে এখনই ব্যবস্থা নিতে পারে। সাবাশ বাংলাদেশ। বাংলাদেশের অর্থনীতি, সামরিক শক্তি এবং রাষ্ট্রের আকার কোনো দিক থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে টক্কর দেয়ার মতো অবস্থা নেই। তা হলে এরকম একটি হম্বিতম্বি কেন করলাম? তার কোনো সুনির্দিষ্ট যুক্তি নেই। যুক্তি হলো আমারও দেখিয়ে দিতে পারি যে, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় আমাদের কিছুই আসে যায় না।
ব্যাপারটা কি ঠিক সে রকম? যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার অনেক ডালপালা আছে। যেমন এই নিষেধাজ্ঞা কেবল র্যাব ও এর সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নয়। এই নিষেধাজ্ঞা আরো সুদূর বিস্তৃত। যেমন প্রতিষ্ঠান হিসেবে র্যাব ও এর সাত কর্মকর্তার কোনো আত্মীয়স্বজন সন্তানসন্ততি স্ত্রী পর্যন্ত বিস্তৃত। এদের কেউই যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাবে বলে মনে হয় না। এ ছাড়া মার্কিন গার্মেন্ট ক্রেতারা বিজিএমইএকে জানিয়ে দিয়েছে যে, র্যাব ও এর পরিবারের সাথে সংশ্লিষ্ট কেউ যদি বিজিএমইএ’র কোনো কারখানার সাথে জড়িত থাকে তবে তাদের পাওনা টাকা পরিশোধের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে। আর সেই অনিশ্চয়তা যদি দেখা দেয় তাহলে ক্রেতারা তার দায় নেবেন না। তারা বলছেন, সেরকম অর্থ মার্কিন রাজস্ব বিভাগ আটকে দিতে পারে। ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। বিজিএমইএ ইতোমধ্যে সে উদ্বেগ প্রকাশও করেছে। বিষয়টা এমন যে, রফতানিকারক কোনো প্রতিষ্ঠানের সাথে যদি র্যাব ও এর কর্মকর্তাদের যদি কোনো শেয়ার থাকে তবে সেই অর্থপ্রাপ্তি অনিশ্চিত। এতেও সরকারের কানে পানি গিয়েছিল কি না বোঝা যায় না। তবে চাপা খানিকটা বন্ধ হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সোজাসাপটা কথা বলেন; কিন্তু কূটনৈতিক ভাষা এত সোজাসাপটা নয়। কূটনৈতিক কার্যক্রমও খুব একটা সরল পথে চলে না। যেমন কোনো কারণে পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে ভারতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তলব করলে দেখা যায় যে, পরদিনই পাকিস্তান ভারতীয় হাহকমিশনারকে তলব করে দু’কথা শুনিয়ে দেয়। কূটনৈতিকভাবে তলব সিদ্ধ কিন্তু সবসময় দু’কথা শোনানো যায় না। যেমন র্যাব ও কর্মকর্তাদের নিষেধাজ্ঞার পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছিল; কিন্তু তার পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে দু’কথা শুনিয়ে দেয়নি। কিন্তু এর জন্য কখনো যে বাংলাদেশকে কোনো মূল্য দিতে হবে না এমন কিন্তু নয়।
পৃথিবীর পরাশক্তিগুলোর হাতে নানা ধরনের অস্ত্র আছে। সবসময় গুলি করে বা কামান দেগে সব সমাধান করতে হয় না। পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়াকে ইউক্রেনে আক্রমণ করতে নিষেধ করেছিল; কিন্তু রাশিয়া সে কথা শুনেনি। রাশিয়া যদি মনে করে থাকে যে, সে সামরিক শক্তি দিয়ে শুধু ইউক্রেন কেন, আশপাশের ছোট দেশগুলোকে দখল করে নেবে তাহলে সেটি হবে মারাত্মক ভুল। পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনের আবেদন অনুযায়ী এখনো তাকে ন্যাটোতে নেয়ার কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। কিন্তু রাশিয়া বিরাট অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে।
পশ্চিমা দেশগুলোয় অর্থ লেনদেনের নেটওয়ার্ক সুইফট। ইতোমধ্যে সেখান থেকে রাশিয়াকে বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর কারণে বিশ্ব-অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্র দেশগুলো রাশিয়ার বিভিন্ন ব্যাংক সুইফট থেকে নিষিদ্ধ করতে একমত। বিবিসিকে জার্মান সরকারের এক মুখপাত্র বলেছেন, রাশিয়াকে আন্তর্জাতিক অর্থপ্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে এমন সিদ্বান্ত নেয়া হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ নেটওয়ার্ক থেকে বাদ পড়ায় এখন দেশটির আর্থিক প্রবাহে ব্যাপকভাবে প্রভাব পড়বে। রাশিয়া তাদের তেল ও গ্যাস রফতানির জন্য সুইফট সিস্টেমের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। পশ্চিমা দেশগুলোর এই পদক্ষেপে রাশিয়ার সাথে ব্যবসা করছে এমন দেশগুলো ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। সুইফট বা সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টার ব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন হলো একটি অত্যধিক নিরাপদ মেসেজিং সিস্টেম যা আন্তর্জাতিক লেনদেনকে সহজ দ্রুত ক্রসবর্ডার পেমেন্ট এবং আন্তর্জাতিক ব্যবসা সহজে পরিচালনা করতে দেয়। বেলজিয়াম-ভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বের অন্তত ১১ হাজার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে লেনদেনের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন দের লায়েন বলেন, মিত্ররা রাশিয়াকে তার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্পদ যুদ্ধের জন্য ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখতে এমন পদক্ষেপ নিয়েছে। তাই এর লেনদেন স্থগিত করতে কোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তার সম্পদের অবসান থেকে বিরত রাখতে সম্মত হয়েছেন। সেই সাথে গোল্ডেন পাসপোর্টধারী রাশিয়ানদের দেশগুলোতে ক্র্যাকডাউনের কথাও বলেছে যাতে রাশিয়ানদের সাথে সম্পর্ককৃত ধনী ব্যক্তিরা দেশগুলোতে নেটওয়ার্কে প্রবেশ করে আর্থিক লেনদেন করতে না পারেন।
রাশিয়ার জন্য সুইফট নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে তাতে বাংলাদেশের কী। ভাগ্যিস, এখনো আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিংবা পররাষ্ট্র সচিব এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা ও আন্তর্জাতিক লেনদেন ব্যবস্থা সুইফট থেকে দেশটির কয়েকটি ব্যাংককে বের করে দেয়ায় বাংলাদেশ নানা দিক থেকে বিপাকে পড়তে পারে। তারা বলছেন, শুধু রূপপুর নয়, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ ও আমদানি রফতানিতে এর প্রভাব পড়বে। রাশিয়ার ১২টি ও বেলারুশের দু’টি ব্যাংকে সুইফট থেকে তালিকাচ্যুত করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞা ১২ মার্চ থেকে কার্যকর হবে। এর মধ্যে একটি ব্যাংক থেকে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের লেনদেন অর্থ লেনদেন হতো। ব্যাংক ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ফরেন ইকোনমিকস অ্যাফেয়ার্স (বিইবি) নামে রাশিয়ার ওই ব্যাংক কয়েক দিন আগেই বাংলাদেশ ব্যাংককে সুইফট ব্যবস্থার মাধ্যমে পাঠানো একটি বার্তায় আপাতত তাদের সাথে লেনদেন করতে নিষেধ করেছে। নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা অন্যান্য ব্যাংকের কাছ থেকেও বাংলাদেশী ব্যাংকগুলোর কাছে এমন বার্তা এসেছে। এই বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, ‘সুইফটের নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়া ব্যাংকগুলোর সাথে আমাদের যত আমদানি-রফতানি ঋণপত্র আছে সবই আটকে যাবে। রাশিয়া বিশ্ব লেনদেন ব্যবস্থা থেকে পুরোপুরি তালিকাচ্যুত হলে রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প আটকে যেতে পারে। কাজ আটকে গেলে এর ভবিষৎ কী তা অনিশ্চিত। … এই মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২-এর কথা আমাদের ভুলে যাওয়াই ভালো’। ১১৪০০০ কোটি টাকার ব্যয় ধরা হয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের। কেন্দ্র নির্মাণের জন্য ৯১ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে রাশিয়া। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ প্রকল্প নিয়ে দুই দেশের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই সমঝোতা কতটা এগোবে তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। রাশিয়া গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা শুরু করেছে। এরপর পশ্চিমারা নানামুখী নিষেধাজ্ঞা জারি করে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন আর কোনো নিষেধাজ্ঞা না দিতে পশ্চিমাদের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
বাংলাদেশের রফতানিকারকরা সুইফট নিয়ে ইতোমধ্যে সঙ্কটে পড়ে গেছেন। ব্যবসায়ী ও ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, এক দিকে যেমন ঋণপত্র খুলতে সমস্যা হচ্ছে অন্য দিকে রাশিয়ার বাজারে পোশাকের চাহিদায় ধস নেমেছে। একসময় রাশিয়ান মুদ্রা এক রুবলের দাম ছিল বাংলাদেশী টাকায় ২০ টাকা। এখন এক রুবলের দাম দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশী মুদ্রায় ৭০ পয়সা। রাশিয়ান অর্থনীতির ধস এই পর্যায়ে পৌঁছেছে।
এবার তাহলে কী হবে? তাজেলের বাবা আর রহিম বাদশাহর তরবারি বের করে ঠোকাঠুকি করতে করতে বলবে নাকি ‘ধরো অস্ত্র করো রণ’।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com