ফেরার পথ নেই : মারুফ কামাল খান - জনতার আওয়াজ
  • আজ সকাল ৬:৪৫, সোমবার, ২৪শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১০ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৪শে রমজান, ১৪৪৬ হিজরি
  • jonotarawaz24@gmail.com
  • ঢাকা, বাংলাদেশ

ফেরার পথ নেই : মারুফ কামাল খান

নিজস্ব প্রতিবেদক, জনতার আওয়াজ ডটকম
প্রকাশের তারিখ: সোমবার, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২৫ ৪:২৩ অপরাহ্ণ পরিবর্তনের তারিখ: সোমবার, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২৫ ৪:২৩ অপরাহ্ণ

 

যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত মুভি ‘দ্য ডার্ক নাইট’-এ হার্ভি ডেন্ট চরিত্রের একটি দুর্দান্ত সংলাপ আছে। সেটি হচ্ছে : ‘You either die a hero or you live long enough to see yourself become the villain.’ এর বঙ্গানুবাদ করলে এমনটাই দাঁড়ায় : ‘হয় তুমি একজন নায়ক হিসেবে মরবে, নয়তো নিজেকে একজন খল চরিত্রে পরিণত হতে দেখার জন্য অনেক বেশিদিন ধরে বেঁচে থাকবে।’ ক্রিস্টোফার নোলান পরিচালিত সিনেমাটি মুক্তি পায় ২০০৮ সালে। এই সুপারহিরো চলচ্চিত্রে হার্ভি ডেন্ট চরিত্রে অভিনয় করেন অ্যারন একহার্ট।

Advertisement: 3:03

Close PlayerUnibots.com
ডায়ালগটি অনেক দিন মনে দাগ কেটে ছিল। বয়স বাড়ার সঙ্গে বিস্মৃতির ধুলোর আস্তরণে ঢাকা পড়ে গেছে জীবনের কত কিছু। ভুলে গিয়েছিলাম দারুণ ওই ডায়ালগটিও। আচানক সেদিন ঢাকায় কৈশোরোত্তীর্ণ এক বাংলাভাষী তরুণের মুখে চোস্ত আমেরিকান ইংলিশ অ্যাকসেন্টে ওই ডায়ালগটি শুনলাম। কতই বা বয়স ছেলেটির? ১৬-১৭ বছর হতে পারে। আমার সন্তানদের চেয়েও কম বয়সী সে। তার উচ্চারণে ওই ডায়ালগ চৈতন্যে কশাঘাত হেনে আমাকে সচকিত করল। তাতে আমার পুরনো স্মৃতিই কেবল জেগে উঠল না। আমার মধ্যে জন্ম নিল এক অব্যক্ত অনুভূতি। মাথার মধ্যে ঘুরতে লাগল কবি-কিশোর সুকান্তের বিখ্যাত কবিতা ‘ছাড়পত্র’-এর সেই কালজয়ী চরণ : এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান; জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে চলে যেতে হবে আমাদের।

ছেলেটিকে আমি সামনাসামনি দেখিনি। দেখেছি টেলিভিশনের পর্দায়। ভারতে আশ্রিত বাংলাদেশের পতিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের ছাত্রসমাজ ও জনগণের উদ্দেশে রাজনৈতিক বক্তৃতা করার কর্মসূচি দেন। সামাজিক মাধ্যমে তার ওই বক্তৃতা প্রচারের কর্মসূচি ছিল ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে। এর প্রতিবাদে ধানমণ্ডিতে শেখ মুজিবুর রহমানের পোড়োবাড়িতে অভিযান চালায় ঢাকার ছাত্র-জনতা। হাসিনার বাবার ওই বাড়িটিতে আগে থেকেই মুজিব পরিবারের স্মৃতি জাদুঘর চালু করা হয়। হাসিনার পতনের পর বাড়িটি ক্রুদ্ধ বিক্ষোভকারীদের রোষানলের শিকার হয়। ৫ ফেব্রুয়ারি সেটি আবার দ্বিতীয়বারের মতো আক্রান্ত হয়। বিপুলসংখ্যক ক্রুদ্ধ মানুষ দলে দলে এসে বাড়িটিতে আগুন দেয় এবং প্রায় পুরোটাই ভেঙেচুরে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। ঘটনাস্থলে পুলিশ ও সেনাদল এলেও তারা উন্মত্ত জনতাকে বাধা দিতে গিয়ে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটানোর ঝুঁকি নেয়নি।

দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ঘটনার সচিত্র বিবরণ ধারণ ও প্রচার করে। এর মধ্যে যমুনা টিভিতে আমি ওই তরুণের সাক্ষাৎকার দেখতে ও শুনতে পাই। ছেলেটি বলতে থাকে, অনেকটা উৎসাহ নিয়েই অনেকক্ষণ আগে সে ঘটনাস্থলে এসেছে। পরিস্থিতি দেখে তার মধ্যে মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে বলে সে উল্লেখ করে। এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ছেলেটি বলল, একাত্তরের আগের শেখ মুজিব আমাদের হৃদয়ের বঙ্গবন্ধু। আর একাত্তরের পরে তার ভূমিকার ফলাফল কী তার প্রতীক আপনারা দেখতে পাচ্ছেন। এই বলে ছেলেটি জনতার রুদ্ররোষে ভূলুণ্ঠিত মুজিব-ভবনের ধ্বংসস্তূপের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে। তারপর আমাকে আরও বেশি চমকে দিয়ে বালক হার্ভি ডেন্ট-এর সংলাপটি বলে ওঠে এবং শেখ মুজিব ও হাসিনার ক্ষেত্রে এটিই ঘটেছে বলে সে উল্লেখ করে। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে হিরো থেকে ভিলেন হওয়ার ইতিবৃত্ত ওই বালকের মুখে এক ঝটকায় শুনে স্তম্ভিত হওয়া ছাড়া আমার আর কিছুই করার ছিল না।

অন্যের কথা জানি না, আমার জন্য আরও বিরাট বিস্ময় ছিল অপেক্ষমাণ। ভবনের ধ্বংসস্তূপের দিকে ইঙ্গিত করে ছেলেটি আরও বলল, আগামীতে যারাই ক্ষমতায় আসবে, যে দলই সরকারে আসবে তাদের মনে রাখতে হবে যে, তারাও যদি মুজিব ও হাসিনার মতো একই রকম কার্যকলাপ করে, তবে তাদের শেষ পরিণতিও কিন্তু এ রকমই হবে। বালক নিজেকে জেন-জি বা জেনারেশন জেড-এর অন্তর্ভুক্ত উল্লেখ করে শেষে যে মাস্টারস্ট্রোকটি করল সেটি হলো, পতিত ফ্যাসিবাদী শাসক শেখ হাসিনার নাম ধরে সে ইংরেজিতে বলে : শেখ হাসিনা ইউ হ্যাভ মেস্্থ দ্য রং জেনারেশনÑ শেখ হাসিনা, ভুল প্রজন্মের সঙ্গে লাগতে গিয়েছিলেন আপনি।

সবটা দেখেশুনে অনেকটা ভ্যাবাচেকা খাওয়ার মতো দশা আমার। হঠাৎ আমার মাথায় এলো তারেক রহমানের কথা। কেন এলো জানি না। হয়তো শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও বেগম খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমান ওরফে পিনোকে ওই রকম বয়সেই আমি দেখেছিলাম বলে। অথবা ওই বয়সে তারেক রহমানের চুলের ছাঁট আর এই ছেলেটির হেয়ার কাটের মধ্যে সাদৃশ্য রয়েছে বলেও হয়তো তরুণ তারেক রহমান আমার স্মৃতিতে উদয় হয়েছেন। দুজনের মুখের হাসির মধ্যেও অনেক মিল আছে বলে মনে হয়েছে আমার। যদিও তারেক রহমান ফর্সা এবং ছেলেটি একটু কালো দেখতে। তারেক রহমান ও আলোচ্য জেন-জি স্মার্ট বয়টির মধ্যকার সিমিলি নিয়ে ভাবতে গিয়ে কয়েকদিন ধরে আলোচিত একটি সংবাদ মাথায় এলো। যুক্তরাষ্ট্রে যে ব্রেকফার্স্ট প্রেয়ারে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভাষণ দেন, সেই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত তারেক রহমানকে প্রতিনিধিত্ব করতে শামিল হয়েছে লন্ডনপ্রবাসী তারেক-কন্যা ব্যারিস্টার জায়মা রহমান। হায়, সময় কত দ্রুতগামী ধাবমান অশ্ব! যে তারেক রহমানকে তার গুণগ্রাহীরা ‘তারুণ্যের অহংকার’ বলে পরিচিত করতে স্বাছন্দ্য বোধ করে, তাকেই প্রতিনিধিত্ব করার উপযুক্ততা আজ অর্জন করেছে তারই কন্যা। আবার সুকান্তের কবিতার লাইন ঘুরছে মাথায়। নতুন শিশুর জন্য স্থান ছেড়ে দিয়ে সরে যেতে হবে আমাদের।

নতুনদের, তরুণদের মতো চিন্তার তীক্ষèতা যে আমাদের নেই তা আমি ওই বালকের কথা শুনেই বিলক্ষণ বুঝে গেছি। গণরোষে বিধ্বস্ত ধানমণ্ডির মুজিব-ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে আমি কিন্তু অমন করে ভাবতে পারতাম না। পারতাম না অত সহজ করে অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে। তাই আমরা যা পারিনি, ওরা তা পেরেছে। আমরা যা পারব না, সেই অসম্ভবকেই সম্ভব করবে ওরা। হাসিনার ফ্যাসিস্ট রেজিমের জগদ্দল পাথর আমরা তো ষোলো বছরেও নড়াতে পারিনি। ওরা কিন্ত অবলীলায় মাত্র দেড় মাসেরও কম সময়ে হাসিনাকে টেনে-হিঁচড়ে নামিয়ে পালাতে বাধ্য করেছে। ওরা পরম দুঃসাহস নিয়ে বন্দুকের নলের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে অকাতরে যেভাবে প্রাণ দিয়েছে, আমরা তো তা পারিনি। তাই হাসিনার দিকে প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ ছুড়ে ওদেরই বলা সাজে : ‘আপনি ভুল প্রজন্মের সঙ্গে লাগতে গিয়েছিলেন!’

শেখ হাসিনার কথা ভাবতে গিয়ে তার একটা বিখ্যাত উক্তির কথা মনে পড়ল। ‘এক দিনও শান্তিতে থাকতে দেব না।’ সেটা ১৯৯১ সালের কথা। বিএনপি তখন ভাঙাচোরা দল। জেনারেল এরশাদ অনেক নেতাকর্মী ভাগিয়ে নিয়ে গিয়ে দলটিকে জরাজীর্ণ করে ফেলেছেন। খালেদা জিয়া আপসহীন মনোভাব নিয়ে ছাত্র-তরুণদের নিয়ে এরশাদের স্বৈরশাসনবিরোধী টানা লড়াই চালিয়েছেন এবং অবশেষে এরশাদকে পরাস্ত করেছেন। তারপর এলো জাস্টিস সাহাবুদ্দীনের নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন। আওয়ামী লীগ সে নির্বাচনে তাদের বিজয় সম্পর্কে নিশ্চিত ছিল। তালিজোড়া দেওয়া দল নিয়ে বিএনপি বড়জোর ১০ সিট পেতে পারে বলে হাসিনা মন্তব্য করেছিলেন। অথচ ভোটের ফল হলো পুরো উল্টো। বিএনপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল। খালেদা জিয়া পাঁচ আসনে দাঁড়িয়ে সব কটিতে জিতলেন। হাসিনা তিন সিটে দাঁড়িয়ে গোপালগঞ্জে নিজের পৈতৃক আসনে জিতলেন কেবল। হারলেন রাজধানী ঢাকার দুই সিটে। ক্ষোভে-ক্রোধে হাসিনা বললেন, ভোটে ‘সূক্ষ্ম কারচুপি’ হয়েছে। ড. কামাল হোসেনসহ তার নিজের দলের অনেক নেতাই এই হাস্যকর অভিযোগের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করলেন। এরপর খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হয়ে সরকার গঠন করলেন। ঈর্ষাতুর হাসিনা সখেদে ঘোষণা করলেন :

‘এক দিনও শান্তিতে থাকতে দেব না।’

এটা নিছক কোনো কথার কথা ছিল না। এর পরের ইতিহাস খালেদা জিয়ার সরকারের বিরুদ্ধে ১৭৩ দিন হরতাল, অবরোধ, রেলস্টেশন জ্বালানো, সমুদ্রবন্দর অচল করা, সচিবালয়ে উসকানি দিয়ে ‘জনতার মঞ্চ’ নামে আমলা বিদ্রোহ ঘটানো, সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিমের সঙ্গে যোগসাজশ করে তাকে দিয়ে ক্যুদেতা ঘটানোর ব্যর্থ চেষ্টা, অফিসযাত্রীদের ধরে রাজপথে উলঙ্গ করা, গণকারফিউ জারি, গণ-আদালত নামে স্বাধীনতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে ‘মক’ বিচারসভা বসানো, সরকারি দায়িত্বশীলদের বাসায় মলমূত্র নিক্ষেপ, দিন-তারিখ দিয়ে সরকার উৎখাতের ঘোষণা ইত্যাদি। নৈরাজ্য ও অরাজকতার শেষ ছিল না। এটা ছিল খালেদা জিয়ার প্রথম সরকার আমল। এরপর হাসিনা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এলে বিরোধী দল-মতের ওপর জুলুম-নির্যাতনের বন্যা বইয়ে দেন। ২০০১ সালে আবার খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এলে হাসিনা ফের শুরু করেন মহা অরাজকতার কর্মসূচি, যার সমাপ্তি ঘটে লগি-বৈঠার তাণ্ডবে অনেক মানুষের প্রাণহানির মধ্য দিয়ে।

লগি-বৈঠার তাণ্ডবের পথ ধরে দেশে ওয়ান-ইলেভেন নামের এক অদ্ভুত শাসনব্যবস্থা জারি হয়। দু’বছরব্যাপী সেই শাসনের সুফলভোগী হন হাসিনা। তারা এক নির্বাচনী মহড়ায় হাসিনাকে ক্ষমতায় বসিয়ে নিজেদের ‘সেফ এক্সিট’ বাস্তবায়িত করে। শুরু হয় হাসিনার প্রায় ষোলো বছরব্যাপী দীর্ঘ ফ্যাসিস্ট শাসন। এর প্রতিটি ধাপে হাত পাকিয়ে তিনি ক্রমান্বয়ে মানুষের সব অধিকার কেড়েছেন। গণতন্ত্র হত্যা করেছেন, প্রশাসন, সামরিক বাহিনী, পুলিশ, সীমান্তরক্ষী, বিচার বিভাগ, মিডিয়াসহ সব কিছু দলীয়করণ ও দখল করে তিনি ধাপে ধাপে ভয়ংকর খুনি ও স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছেন। দুর্নীতি-লুটপাট-সম্পদ পাচারে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছেন। উন্নয়ন প্রকল্পগুলো হয়ে উঠেছিল অবাধ লুণ্ঠনের মৃগয়াভূমি। হত্যা, গুম, নির্যাতন, মিথ্যা মামলা, দখল, দলীয়করণে তিনি তার শাসনের ইতিহাসকে করেছেন চরমভাবে কলঙ্কিত। মধ্যযুগীয় সামন্ত শাসকের মতো সদম্ভে তিনি জনগণের সব ইউটিলিটি সার্ভিস বন্ধের হুমকি দিতেন। দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত হলে তিনি তা নিয়ে করতেন নির্মম রসিকতা। সব শেষে চব্বিশ সালে ছাত্র-তরুণদের আন্দোলন দমাতে তিনি নারী-শিশুসহ প্রায় ২ হাজার মানবসন্তানের প্রাণ সংহার করেছেন। তাজা বুলেটে ঝাঁজরা দেহ নিয়ে ৩০ হাজারের বেশি পঙ্গু মানুষ এখনও কাতরাচ্ছে।

হাসিনার পতন ও পলায়নের পর ছয় মাস না পেরোতেই তিনি আবার অধীর হয়ে উঠেছেন। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে তিনি ক্ষমতায় থাকতে বাংলাদেশকে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে কলঙ্কতিলক এঁটে দিয়ে যান। ওই সময়কালেই দেশের সর্বোচ্চ আদালত ফুলকোর্ট এক পর্যবেক্ষণে তাকে ‘রংহেডেড’ বা একগুঁয়ে বলে চিহ্নিত করেন। সেই রংহেডেড নারী আবারও তার ‘এক দিনও শান্তিতে থাকতে না দেওয়ার’ কর্মসূচি জারি করেছেন। নিজে ক্ষমতায় থাকতে না পারলে দেশকে, দেশের মানুষকে, সরকারকেÑ কাউকেই তিনি এক দিনও শান্তিতে থাকতে দেবেন না। সেটাই তার বরাবরের নীতি। এবারও তাই শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে তিনি হরতাল-বিক্ষোভসহ ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে আন্দোলনের নানা কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। তিনি ফোনে নেতাকর্মীদের উসকাচ্ছেন। মিথ্যা ও উসকানিমূলক প্রচারণা চালাচ্ছেন। বক্তৃতা করে ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানকে ষড়যন্ত্র বলে ধৃষ্টতামূলক মন্তব্য করছেন। ইট-কংক্রিট-লোহার স্থাপনার ক্ষয়ক্ষতি দেখে যিনি কাঁদেন, তিনি হাজার হাজার মানুষকে হতাহত করে একটু অনুশোচনাও বোধ করেন না। বরং কারফিউ দিয়ে, ইন্টারনেট বন্ধ করে, দেখামাত্র গুলির হুকুম দিয়ে সেনা, পুলিশ, র?্যাব, সীমান্তরক্ষী, আনসার ও দলীয় সন্ত্রাসীদের দিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে তিনি যে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছেন তার দায় আন্দোলনকারীদের ওপর চাপাচ্ছেন। দেশকে বৈদেশিক ঋণের ভারে জর্জরিত করে এবং লুট করে বিদেশে সম্পদের পাহাড় জমিয়ে তিনি জাতিকে কেবল দিয়েছেন বলে কৃতিত্বের গল্প শোনান। সন্ত্রাসের দানব ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগকে আবারও আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস চালানোর আহ্বান জানান তিনি। এই উসকানি কি তরুণরা মানবে?

এই রাষ্ট্রকে একটি অকেজো পরিত্যক্ত জমিদারি বানিয়ে হাসিনা পালান। পুলিশ, প্রশাসন, বিচার বিভাগসহ রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠান অকেজো। তার বড় সহযোগীরা পালিয়েছে। ছোট দোসররা ঘাপটি মেরে বসে সব কিছু অকেজো করার চক্রান্তে লিপ্ত। এমন নজিরবিহীন এক নাজুক অবস্থায় ড. ইউনূসের নেতৃত্বের ২০/২৫ জন অরাজনৈতিক ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত টেকনোক্র?্যাটদের একটি অন্তর্বর্তী সরকার পর্বতপ্রমাণ সমস্যা রাতারাতি সামলে উঠবেÑ এমন দাবি মতলববাজ ও মূর্খ ছাড়া কেউ করবে না। এ সরকার যাতে মোটেও কাজ করতে না পারে সেই উদ্দেশ্যে হাসিনার ছদ্মবেশী অনুচররা ষোলো বছরের নৈঃশব্দ ভেঙে নানা বর্ণের দাবি নিয়ে পথে নেমে যায়। সব কিছু বিস্ময়করভাবে সামলে নিয়ে ড. ইউনূসের সরকার যেই দেশবাসীকে একটুখানি স্বস্তির কাছাকাছি এনেছে, অমনি হাসিনা নিজে নেমে পড়েছেন।

নিজে সশরীরে জনগণের সামনে আসার কিংবা অভিযোগ মোকাবিলার সৎসাহস তার নেই। নিজেরা সপরিবারে বিদেশে নিরাপদে থেকে তার অপকর্মে বিপন্ন নেতাকর্মী-সমর্থকদের হাসিনা ব্যবহার করতে চাইছেন সরকারের বিরুদ্ধে, দেশের বিরুদ্ধে, জনগণের বিরুদ্ধে, শান্তির বিরুদ্ধে এবং নিরাপত্তার বিরুদ্ধে। ছয় মাসেই তার আর তর সইছে না। এখুনি আবার হারানো স্বর্গ ফিরে পাওয়ার জন্য সন্ত্রাস চালাতে হবে, মিথ্যার তুবড়ি ছোটাতে হবে, উসকানি দিতে হবে। তিনি তার নিজের পরিবার, দল ও অপরাজনীতিকে মুক্তিযুদ্ধের সমার্থক বলে প্রচার করেন। এগুলোকে তিনি সারাদেশের জনগণের ওপরে স্থাপন করেন। দেশবাসীর প্রতি তিনি কোনো কৃতজ্ঞতা অনুভব করেন না। বরং মনে করেন তাদের কাছেই সারাদেশের জনগণের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। হাসিনার এই সামন্তবাদী ভাবনা, জনগণের চেয়ে ব্যক্তিকে বড় করে দেখানোর ব্যক্তিপূজা ও বিকৃত ইতিহাসনির্ভর বয়ান এবং প্রতারণা ও বিভেদের অপরাজনীতি কি নতুন প্রজন্ম মানবে? তিনি কি অস্থিরতা ছড়ানোর পুরনো অপকৌশলে তরুণদের বিপথগামী করতে পারবেন? সন্ত্রাস তার এক বিরাট ব্রহ্মাস্ত্র, কিন্তু এ দেশের আগামী প্রজন্ম যে ব্যালান্স অব টেরর অর্থাৎ লালসন্ত্রাস দিয়ে শ্বেতসন্ত্রাস মোকাবিলার কৌশল জানেÑ তা তো ইতোমধ্যে প্রমাণিত। কাজেই সাধু সাবধান! শেখ হাসিনা, আপনি ভুলেও আর ভুল প্রজন্মের সঙ্গে লাগতে আসবেন না। মৃত আর ধ্বংসস্তূপ পিঠে আপনি পালিয়ে গেছেন। আপনার আর ফেরার কোনো পথ নেই।

মারুফ কামাল খান : সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক

ই-মেইল : সৎভংযষ@মসধরষ.পড়স

Print Friendly, PDF & Email
 
 
জনতার আওয়াজ/আ আ
 

জনপ্রিয় সংবাদ

 

সর্বোচ্চ পঠিত সংবাদ