বাংলাদেশে গণতন্ত্রের আশা ফুরিয়ে যাচ্ছে
নিজস্ব প্রতিবেদক, জনতার আওয়াজ ডটকম
প্রকাশের তারিখ:
বৃহস্পতিবার, মার্চ ৭, ২০২৪ ১১:২২ অপরাহ্ণ পরিবর্তনের তারিখ:
বৃহস্পতিবার, মার্চ ৭, ২০২৪ ১১:২২ অপরাহ্ণ
সাইমুম পারভেজ
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি একটি বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পুনরায় তার ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছেন। দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও তার মিত্র শক্তিগুলোর বর্জনের পরও ওই নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনুপস্থিতি এবং ভিন্ন মতের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি সহিংস দমন-পীড়নের কারণে আন্তর্জাতিক মহলেও এ নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে আগেই উদ্বেগ জাগে। আন্তর্জাতিক এই উদ্বেগ সত্ত্বেও পশ্চিমা শক্তিরা এই সরকারের সাথে কাজ করছে, যদিও দেশটিতে চীনের প্রভাব বাড়ছে। আওয়ামী লীগের ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদ, অর্থনৈতিক দুরবস্থা এবং সামাজিক অস্থিরতার ভেতর দিয়ে চলা ২০২৪ সালটি বাংলাদেশের জন্য আরও সংকটময় হয়ে উঠতে পারে।
২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে যে নির্বাচনটির আয়োজন করে সেটি কোনোভাবেই অবাধ ও সুষ্ঠু ছিল না। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এই নির্বাচনকে ভুয়া আখ্যা দিয়ে গণতন্ত্রের জন্য একটি ‘খারাপ দিন’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। এই নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও সমমনা দলগুলো বর্জন করায় আওয়ামী লীগ তাদের নিজেদের প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। যেখানে নির্বাচনে প্রার্থীর বিজয় অনেকটা আগে ভাগেই আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারিত হয়ে যায়।
নির্বাচনের সময় বিরোধী দল ও ক্ষমতাসীন দলগুলোর মধ্যে ব্যাপক বিক্ষোভ ও পাল্টা সমাবেশ হয়। বিএনপির নেতৃত্বাধীন সমমনা দলগুলো রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে সমাবেশে বিপুল সমাগম ঘটায়।
এসব সমাবেশে তাদের প্রধান দাবি ছিল- নির্বাচনকালীন নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন দুটি ব্যাপকভাবে ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় এবারের নির্বাচনে তাদের এই দাবির যথেষ্ট ভিত্তি ছিল। এর বিপরীতে ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ এবং সর্বশেষ ২০০৮ সালের নির্বাচনগুলো অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য হিসেবে সর্বব্যাপী স্বীকৃতি পায়। যে কারণে ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিলুপ্ত করলে বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের একটি বড় অংশ তার প্রতিবাদ করে।
২০২৩ সালের মে মাসে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেন। তাতে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে যারা বাধাগ্রস্ত করে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়। এর ফলে বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা মনে করেছিলেন যে, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের থেকে ২০২৪ সালের নির্বাচন ভিন্ন হবে। কেন-না আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ নির্বাচনকে ঘনিষ্টভাবে নজরদারি করছে।
মার্কিন এই ভিসা নীতি অবশ্য রাশিয়া ও চীনকেও ভাবিয়ে তোলে। কেন-না তারা শেখ হাসিনার পক্ষ নিয়েছিল এবং এটাকে তারা বাংলাদেশে ‘পশ্চিমা হস্তক্ষেপ’ বলে উল্লেখ করে। বাংলাদেশের ওপর সরাসরি প্রভাব বিস্তারকারী প্রতিবেশি রাষ্ট্র হিসেবে ভারতও চেয়েছিল শেখ হাসিনা আবারও ক্ষমতায় থাকুক; যাতে তাদের বাণিজ্য ও নিরাপত্তা বলয় অক্ষুণ্ণ থাকে।
অবশ্য এই প্রভাব বিস্তারের খেলায় প্রকৃতপক্ষে হেরেছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ, যারা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর সরকার রাজধানীতে বিএনপি মহাসমাবেশে হামলা করে সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। ওই বছরই হাজার হাজার নেতাকর্মীকে রাজনৈতিক বিচারের নামে সাজা প্রদান করে। বিরোধী নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার, হেফাজতে মৃত্যু এবং বিচারবহির্ভূত হত্যার পাশাপাশি বর্তমান সরকার কাল্পনিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলায় বিচারিক নিপীড়ন ত্বরান্বিত করেছে।
অন্তত ২৭ হাজার নেতাকর্মীকে কারাগারে পাঠানো হয় এবং আগস্টের পর থেকে এক লাখেরও বেশি রাজনৈতিক কর্মীকে সাজা দেওয়া হয়। সাংবাদিক, কার্টুনিস্ট এবং সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্টদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ব্যবহার করে গ্রেপ্তার ও সাজা দেওয়া হয়।
বিএনপিসহ ৬২টি দল ২০২৪ সালের এ নির্বাচনকে বর্জন করে তখন নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক দেখানোই সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। শাসকদল আন্তর্জাতিক শক্তিকে দেখাতে ‘ডামি ক্যান্ডিডেট’ নামের একটি ধারণা দাঁড়া করায়। যেখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী যারা কি-না তাদের দলেরই লোক হবে। তাদের বিজয়কে আওয়ামী লীগের বাইরের লোকের বিজয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হবে। প্রকৃতপক্ষে সেটি হয়নি। সবখানেই প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগ ভোট হয়েছে।
নির্বাচনের দিন সকাল থেকেই সারা দেশের ভোট কেন্দ্রগুলো ছিলো ফাঁকা। কিন্তু যেখানে কোনো বিদেশি পর্যবেক্ষক গিয়েছে সেখানেই ভোটারের কৃত্রিম সারি তৈরি করা হয়। এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ বিদেশিদের বোঝাতে চেয়েছিল যে নির্বাচনে সাধারণ ভোটারদের উপস্থিতি রয়েছে। নির্বাচনে প্রকাশ্যে ব্যালটে সিল মারার পাশাপাশি শিশুদেরও ভোট দিতে দেখা গেছে। তবে কেন্দ্রে ভোটার শূন্যতা এবং সাধারণ মানুষের বর্জনের পরও নির্বাচন কমিশন এই নির্বাচনে ৪১.৮ শতাংশ ভোট জমা হয়েছে বলে ঘোষণা করেছে।
নির্বাচনে ২৯৮ জন বিজয়ী সংসদ সদস্যের মধ্যে ২৯৫ জনই সরকারিভাবে ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত। অথবা, তারা স্বতন্ত্র হলেও প্রকৃতপক্ষে প্রাক্তন মন্ত্রী কিংবা তাদের জোটসঙ্গী জাতীয় পার্টির সদস্য ছিলেন।
২০২৩ সালে বাংলাদেশ জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক রিজার্ভ হ্রাস এবং ব্যাপকমাত্রার দুর্নীতিসহ বেশ কিছু বিষয়ে সংকটে পড়ে। নির্বাচনে ভোটারের এতো কম উপস্থিতি বর্তমান সরকারের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার প্রতি জনগণের অসন্তোষের প্রতিফলন হিসেবে মনে করা হচ্ছে। ২০২৩ সালে তৈরি পোশাক শ্রমিকরা মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে বিক্ষোভ করে। তবে পুলিশ বিক্ষোভ দমাতে ব্যাপকভাবে দমন-পীড়ন চালায়। তারা কয়েকজন শ্রমিককে হত্যা করে।
যদি জনগণের ভোটাধিকার থাকে তাহলে যে কোনো গণতান্ত্রিক সরকারই এই ধরনের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং নৃশংস দমন-পীড়ন চালাতে ভয় পাবে। কিন্তু যেহেতু নির্বাচন প্রধান বিরোধীদল বিএনপি বর্জন করেছিল তাই জনগণ সরকারের বিপক্ষের দলকে ভোট দিয়ে তাদের সেই অসন্তোষ প্রকাশ করতে পারেনি। এ কারণে তারা নির্বাচনে ভোট কেন্দ্রে যায়নি।
মার্কিন ভিসা নীতি, নির্বাচন নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদের ঢাকা সফর এবং অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ইস্যুতে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তাদের নানামুখী যোগাযোগ কাজে আসেনি। এমনকি নির্বাচনের পরে ওই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি বলেও বিবৃতি দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়া নির্বাচনের সময় বিশ্বাসযোগ্য, উন্মুক্ত এবং ন্যায্য প্রতিযোগিতা অভাব ছিল বলে বিবৃতি দেয় যুক্তরাজ্যও।
তবে এখন পশ্চিমা বিশ্ব বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করছে। বর্তমান সরকার চীনের সঙ্গে সম্পর্কের পরিধি বাড়াচ্ছে। সরকারের এই প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলে ২০২৪ সালটি বাংলাদেশে চীনের শক্তিশালী অবস্থানের সাক্ষী হতে পারে। তবে অভ্যন্তরীণভাবে একদলীয় সরকারের ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা, অবনতিশীল অর্থনৈতিক অবস্থা এবং ক্রমবর্ধমান জ্বালানি সংকটের কারণে এ বছরই সহিংস অস্থির পরিস্থিতির সৃষ্টে হতে পারে।
(লেখাটি ইস্টএশিয়া ফোরাম থেকে ভাষান্তরিত)
লেখক: ড. সাইমুম পারভেজ, ম্যারিকুরি পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চ ফেলো, ফ্রাই ইউনিভার্সিটি, ব্রাসেলস, বেলজিয়াম।