রাজনীতির একাল-সেকাল
নিজস্ব প্রতিবেদক, জনতার আওয়াজ ডটকম
প্রকাশের তারিখ:
রবিবার, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৩ ১২:২১ পূর্বাহ্ণ পরিবর্তনের তারিখ:
রবিবার, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৩ ১২:২১ পূর্বাহ্ণ

তাইফুল ইসলাম টিপু
মানুষ একসময় রাজনীতিতে আসতো মানব কল্যাণে নিজেকে ব্রত করার জন্য। নিজের সংসার ধর্ম পরিবারের সদস্যদের কথা চিন্তা না করে মানুষ এবং সমাজের উন্নয়নে নিজেকে সর্বদা আত্মনিয়োগ করতো। কোন মানুষ যদি বিপদে পড়তো যেমন গরিব অসহায় অসুস্থ, কন্যাদায়গ্রস্থ, গরিব মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়ার বিষয় সহ বিভিন্ন বিষয়ে নিজের অর্থ-সম্পদের পাশাপাশি মানুষের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষুকের ন্যায় ভিক্ষা করে মানব কল্যাণের চেষ্টা করতো। এলাকায় সমাজিক উন্নয়নের জন্য যেমন স্কুল, কলেজ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এমনকি খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করার ক্ষেত্রে নিজে সম্পৃক্ত হতো এবং অন্যকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করতো। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে যারা সম্পৃক্ত হতো তারা নেতার ন্যায়-নিষ্ঠা, সততা, মানব প্রেম, আদর্শের প্রতি অপরিসীম বিশ্বাস, আনুগত্য, শ্রদ্ধাবোধ অতুলনীয় নিয়ে নিজেকে সম্পৃক্ত করতো। নেতার আদর্শ এবং সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে যেয়ে শারীরিক, মানসিক নির্যাতন কষ্ট প্রতিনিয়ত আলিঙ্গন করতো।
তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন ছিল মুখ্য, সেটা আবার প্রচার করতে হবে, মূল নেতৃত্ব কে জানতে হবে এটা কখনো কেউ ভাবতো না কাজটা সুন্দরভাবে সমাপ্ত করাই ছিল তাদের আত্মতৃপ্তির। না করতে পারলে মানসিক যন্ত্রণায় ভুক্ত। নেতার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে অনেক সময় বাবা-মায়ের অবাধ্য হতে কার্পণ্য করত না। অধিকাংশ নেতাই পরিবারের কথা চিন্তা না করে সর্বদা মানুষের কল্যাণে নিজে মশগুল থাকতো। অধিকাংশ নেতারই বাড়ি গাড়ি বলে কিছু ছিল না, থাকলেও তা ভাঙ্গা চুরা, নেতার প্রতি কেউ কোন অসম্মান করলে ছলেবলে কৌশলে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য মরিয়া হতো, নিজেকে প্রচার না করে নেতা এবং দলের আদর্শ প্রচার করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব সাথে দেখা করার চিন্তাই করত না, বরং দলের কাজ করতে করতে অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছে। নেতার নিকট কখনোই কোনো কর্মী মিথ্যা তথ্য দিত না, সেটাকে পাপ মনে করতে সবাই, মিথ্যা তথ্যের উপরে সিদ্ধান্ত নিলে দল ক্ষতিগ্রস্ত হবে তাই সর্বদা নিজ থেকে কর্মীরা উপর পর্যন্ত সঠিক ইনফরমেশন দেয়ার চেষ্টা করতে। নেতার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে কখনো দিনের পর দিনে অধাহারে অনাহারে পার করেছে, মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে কখনো ভ্যান গাড়িতে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে, এক থানা থেকে অন্য থানায়, এক জেলা থেকে অন্য জেলায় পদার্পণ করেছে।
দলের কর্মসূচি বাস্তবায়নে নিজের শারীরিক পরিশ্রমকে স্বাচ্ছন্দ মনে করত। নিজেরাই পোস্টার লাগাতো, মাইকিং করত ওয়ালের চিকা মারতো, কর্মসূচি পালনে কোন বিলাসিতা ছিল না, নেতা এবং কর্মীর মাঝে একে অপরকে সহযোগিতার মানসিকতা পরিলক্ষিত হতো। নিজের আরাম আসের কথা কখনোই ভাবতে দেখা যেত না। পদ নয় রাজনৈতিক সিনিয়রদেরকে জুনিয়ররা প্রতিনিয়ত সম্মান দিতো, যোগ্যতা অনুসারে মূল্যায়ন করা হতো যেমন স্লোগান, বক্তৃতা, সাংগঠনিক দক্ষতা, সাহিত্য, লেখনী সহ বিভিন্ন বিষয় যারা যে বিষয়ে পারদর্শী সেই বিষয়ে তাদেরকে দল থেকে মূল্যায়ন করা হতো। প্রতিনিয়ত কর্মীদের মতামতের ভিত্তিতে সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নেয়া হতো। ইউনিয়নের নেতারা বিশেষ প্রয়োজনে থানাকে অবগত না করে জেলায় যেত না এমনকি জেলার দায়িত্বশীল নেতা ছাড়া কেন্দ্রে সাংগঠনিক বিষয়ে কেউ আসতো না। কর্মীর সংখ্যা বাড়ানোর প্রতিযোগিতা প্রতিনিয়ত থাকতো। কর্মীর প্রতি নেতাদের যেমন দায়বদ্ধতা ছিল কর্মীরাও তদ্রূপ নেতাদের প্রতি আনুগত্য ছিল।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে নিজের এবং নিজ পরিবারের সুখ, ভোগ বিলাসের মাধ্যমে পরিণত হয়েছে রাজনীতি। রাজনীতিতে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ দিন দিন নিঃশেষ হতে চলেছে, নিজের প্রয়োজনে প্রতিনিয়ত মূল নেতৃত্বের কাছে মিথ্যা বলা শিল্পে পরিণত হয়েছে, নিজের উচ্চ অভিলাষ বাস্তবায়নে সকল প্রকার ছল চাতুরতার আশ্রয় নিতে ন্যূনতম দ্বিধা করে না। সিনিয়রদের ন্যূনতম সম্মান দেখায় না। যে কোন কৌশলে পদ পেলেই সিনিয়র হয়ে যায়। যোগ্যতা না থাকলেও নিজেকে অথবা নিজের ছেলে মেয়ে কে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য দলের যোগ্যতা সম্পন্ন নেতা-কর্মীদেরকে নিঃশেষ করে দিতে ন্যূনতম দ্বিধা করে না। মেধাবী দক্ষ কর্মী সমর্থক কমানোর যেন এখন রাজনৈতিক সংস্কৃতি হয়ে গেছে। দলের নেতা এবং নেতার আদর্শ বাস্তবায়নের চাইতে নিজেকেই প্রতিষ্ঠিত করা এবং প্রচার করা বর্তমানে মূল লক্ষ্য।
এছাড়া বর্তমান সোশ্যাল মিডিয়া আসায় এখন রাজনৈতিক নেতাদেরকে রাজনীতি করতে হয় মাত্র ৩০ সেকেন্ড, সময় বুঝে কর্মসূচিতে এসেই নিজে সাথে আনা একজন সমর্থক, অথবা কাউকে দিয়ে একটি ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং প্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিকট পাঠিয়ে দিলেই রাজনীতি হয়ে গেল। আরেকটু বেশি সময় থাকলে শীর্ষ নেতাদের সাথে ছবি তোলা এবং প্রচার করা রাজনীতির মূল লক্ষ্য, অন্যের পরিশ্রম কপিরাইট করে নিজের বলে চালিয়ে দেয়ার প্রবণতা এখন প্রকট যারা কাজ করে তারা ধন্যবাদ তো দূরের কথা আরো অপমানিত হয়, আর কাজ না করে সময়মতো সেটা চুরি করে কর্তৃপক্ষে নিজের বলে জানিয়ে ব্যক্তিগত সকল সুবিধা গ্রহণ করছে এদের চক্র অনেক বেশি শক্তিশালী এরা প্রতিনিয়ত খবর রাখে মূল নেতৃত্ব বর্তমানে কার সঙ্গে যোগাযোগ। এখন কোন ব্যক্তি মারা গেলে জানাযায় গিয়ে হাসে আর ছবি তুলে সেটাও যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করে।
এই শ্রেণীর নেতারা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করার আগে খাবার মেনু, থাকার জায়গা, গাড়ির ব্যবস্থা আরামদায়ক আছে কিনা সেটাই দেখা হয়। যে কর্মী এই কাজটা পারে তাকে বেশি মূল্যায়ন করা হয়, বেশি কর্মী নিয়ে কর্মসূচিতে উপস্থিত হলে তাকে মূল্যায়ন করা হয় না। কর্মসূচিতে এখন সাজসজ্জাতেই বেশি নজর দেয়া হয় যে কর্মসূচিতে খরচ হওয়ার কথা যে পরিমাণ পোস্টার, ফেস্টুন, গেঞ্জি, ক্যাপ অপ্রয়োজনীয় প্রতিযোগিতায় লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে শুধুমাত্র নিজেকে জায়ের করার জন্য যা মূল নেতৃত্বে কোন প্রয়োজন আসে না। সেখানে মূল নেতৃত্বের ছবির চাইতে নিজের ছবিটা অনেক বড় করে প্রচার করে। দুঃসময় দেখলেই এই সকল নেতারা গা ঢাকা দেয়। পোস্টারিং মাইকিং এখন ভাড়া করা লোক দিয়ে করা হয় এটা করা রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা অসম্মান মনে করে। ভালো বক্তা না হয়েও পদের কারণে প্রতিদিন বক্তৃতা সুযোগ পাই, যাদের বক্তৃতা মানুষ শুনতে চাই তাদের পদ না থাকার কারণে মানুষ তাদের বক্তিতা শুনা থেকে বঞ্চিত হয়।
কোনদিন রাজনীতি না করে সাবেক এমপি, মন্ত্রীদের ছেলে-মেয়ে অথবা অর্থবিত্তের মালিক অল্প কিছুদিন রাজনীতি করে অথবা যেদিন পদ পায় সে দিনে রাজনীতি তার প্রথম যাত্রা। তাদের মূল্যায়ন দিন দিন বেড়ে চলেছে। একজন কর্মী সারাদিন দলের জন্য পরিশ্রম করছে, কর্মী সংগ্রহ করছে তার চাইতে আরেকজন সারাদিন আরাম আয়েশ করে নিজের ব্যবসা-বাণিজ্য শেষ করে গাড়িতে চড়ে আসলে তার কদর যেন অনেক বেশি। রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে যারা পদের প্রতিযোগিতায় আছে তারা আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য নয় নিজের সুখ শান্তি তাদের মূল লক্ষ্য, কর্মীদের তারা মনে করে নিম্নমানের চাকর বাঁকর, শুধু রাজনীতি নয় বর্তমানে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী পেশায় এই আত্মকেন্দ্রিক উৎসব প্রকটভাবে সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়াচ্ছে।
যদিও প্রান্তিক পর্যায়ে এখনো অসংখ্য নিবেদিত কর্মী সমর্থক বিদ্যমান তবে পরিবেশ পরিস্থিতি দেখে দিন দিন সংখ্যা কমছে, এই কারণে আগে একটা কর্মী অসম্মানিত হলে দলের সকল নেতাকর্মী প্রতিবাদ প্রতিরোধ করত, আর এখন মূল নেতৃত্ব অসম্মানিত হলেও অন্যান্য নেতারা নিজেদের নিরাপদে অবস্থান নিয়ে কৌশল গত নিজের আত্মপ্রচারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যে কর্মসূচি ৫ ঘন্টার সেই কর্মসূচি শেষ করি ৫ মিনিটে। টকশোগুলোতে মানুষ কথার প্রতিযোগিতা যুক্তি তর্ক শুনে চাই, সত্যটা জানতে চাই, তা না জেনে শিক্ষিত নামধারী কিছু ব্যক্তির অসভ্য আচরণ এবং ভাষা শুনে দেশবাসী হতবাক হয়।
আবার কেউ কেউ সুন্দর করে সেজে এসি রুমে বসে কিছু বলতে পারুক আর না পারুক টকশো করে নিজেকে রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রচার করার চেষ্টা করছে। এতে অনেকে পুরস্কার পেয়েছে তাই তারা মাঠের রাজনীতি করার প্রয়োজন মনে করে না।
রাজনীতিতে এসেছিলাম মানবকল্যাণে নিজেকে ব্রত করার লক্ষ্য নিয়ে একটি আদর্শিক সংগ্রামের, তখন জানতাম রাজনীতি না করলে রাজনীতিবিদ হওয়া যায় না, এখন দেখি যে কোন সময় রাজনীতিবিদ হওয়া যায়, রাজনীতি যেন অবসর সময়ের বিনোদনের একটা অংশে পরিণত করেছে সুবিধাবাদী শ্রেণীর রাজনীতিকরা।
মানুষ একসময় রাজনীতি করতো মানবকল্যাণে নিজেকে ব্রত করার জন্য। বর্তমানে সারাজীবন বিভিন্ন পেশায় অবস্থান করে অবসরে যাওয়ার পরে রাজনীতিতে আসে আরাম টুকু উপভোগ করার জন্য। বাড়ি গাড়ির মালিক হওয়ার জন্য এখন রাজনীতির প্রতিযোগিতা চলছে। বর্তমানে ভোটবিহীন জনপ্রতিনিধি তৈরি হচ্ছে।
করুনায় পদ ধারী খন্ডকালীন নেতা তৈরি হচ্ছে আদর্শিক সাংগঠনিক দক্ষ নেতা তৈরি হচ্ছে না ফলে রাজনীতি চোরাবালিতে বারবার আটকে যাচ্ছে এবং দেশের অগ্রযাত্রা প্রতিনিয়ত বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
রাজনীতি মানেই মানবকল্যাণ এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ। কালের বিবর্তনে আজকে অন্যায় এবং ভঙ্গুর পথ দেখলেই রাজনীতিবিদ নিজেকে নিরাপদে রাখার প্রচেষ্টা করে। শুধু রাজনীতিবিদ নয় সকল শ্রেণী পেশার মানুষরা আজকে নিজেকে নিরাপদে রাখার পথে হাঁটছে এটা দেখে নতুন প্রজন্ম আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে ফলে দেশ জাতি গণতন্ত্র স্বাধীনতা সকল কিছু অস্তমিত হতে চলেছে।
লেখক: বিএনপি’র সহ দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু।
জনতার আওয়াজ/আ আ
