সিন্ডিকেট তত্ত্ব : আবদুল আউয়াল মিন্টু - জনতার আওয়াজ
  • আজ রাত ৮:২৯, সোমবার, ২৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২০শে শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি
  • jonotarawaz24@gmail.com
  • ঢাকা, বাংলাদেশ

সিন্ডিকেট তত্ত্ব : আবদুল আউয়াল মিন্টু

নিজস্ব প্রতিবেদক, জনতার আওয়াজ ডটকম
প্রকাশের তারিখ: শুক্রবার, ডিসেম্বর ২৯, ২০২৩ ৫:৩৫ পূর্বাহ্ণ পরিবর্তনের তারিখ: শুক্রবার, ডিসেম্বর ২৯, ২০২৩ ৫:৩৫ পূর্বাহ্ণ

 

দেশে কোনো একটি পণ্যের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সবাই উচ্চস্বরে বলতে থাকে- ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট বানিয়ে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এমনকি শাক-সবজির দাম বাড়লেও একই কথা শোনা যায়। ভোক্তা অধিকার কমিশনের কর্মকর্তারা দোকানে দোকানে ঘুরতে থাকে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে অবিরত সভা ও মতবিনিময় করেন। পুলিশের পাহারায় ম্যাজিস্ট্রেটরা রাস্তায় নেমে পড়েন। দোকানে দোকানে পণ্যের ক্রয়-বিক্রয় মূল্যের তালিকা পরীক্ষা করেন। তিনি নিজেই সাব্যস্ত করেন যে, দোকানের মালিক বেশি দাম নিচ্ছে। তাই সেই লোভী ও মুনাফাখোর। অতএব সে আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ করেছে। অতঃপর তিনি দোকান মালিকের ওপর জরিমানা ধার্য করেন।

তাদের উপস্থিতিতে পণ্যের দাম কমে যায়। পরের দিন দেখা গেল জরিমানায় ভূষিত খুচরা ব্যবসায়ী ঐ পণ্যের বেচাকেনা বন্ধ করে দিয়েছে। অতঃপর ঐ পণ্যের মূল্য বাজারে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। তাহলে কি কেবলমাত্র মুষ্টিমেয় কিছু খুচরা ব্যবসায়ী, একটা বা দুটি পণ্যের দাম বাড়ালেই মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়? জনগণের জীবনমানে অবনতি ঘটে? খুচরা দোকানের মালিকেরাই কেবল মূল্যস্ফীতির জন্য দায়ী?
যেকোনো পণ্য ভোক্তার নিকট আসার পূর্বে; প্রথম প্রস্তুতকারক বা আমদানিকারক, তারপর পরিবহন ও সঙ্গে চাঁদাবাজি এবং আড়তদার হয়ে শেষ পর্যন্ত খুচরা দোকানে আসে। তাই পণ্যের দাম বাড়ে ধাপে ধাপে, প্রতি ধাপে। কিন্তু জরিমানা গুনতে হচ্ছে একমাত্র খুচরা দোকানের মালিককে। কোনো বুদ্ধিদীপ্ত সমাজে এটা কি সম্ভব? দোকানদার বেশি না কম দাম নিচ্ছেন, এটা নিরুপণ করার দায়িত্ব বা ক্ষমতা কি ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব হয়তো বাজার ব্যবস্থাপনা ও বিভিন্ন ধরনের চাঁদাবাজির কথা শুনে নাই বা জানে না। কিন্তু বেচারা খুচরা দোকানের মালিককে সব হিসাবে আনতে হয়। পণ্য বিক্রি করুক বা না করুক চাঁদা দিতেই হবে। মাফ নেই, যেমন জরিমানা করলে দিতেই হয়। অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন, লেখক নিজেও ঐ গোষ্ঠীর সদস্য, তাই অনৈতিকভাবে লোভী ও মুনাফাখোরদের সমর্থন করতে উঠেপড়ে লেগেছেন। এই অপবাদ পূর্বে অনেক শুনেছি; হয়তো বা ভবিষ্যতেও আরও শুনবো। তাতে আমার দুঃখ নেই।

রাজনীতিবিদ, আমলা ও সরকারের মদতপুষ্ট দুষ্টচক্র (সিন্ডিকেট): বাংলাদেশে আজকাল বহু কিছু ঘটে চলেছে, যা কেবল মূল্যবৃদ্ধি নয় বরং দেশ ও সমাজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ এসব বিষয় নিয়ে কাউকে তেমন কোনো কথা বলতে শোনা যায় না। দেশের বর্তমান রাজনীতি, সমাজ ও অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয়াবলী পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, শাসক দলের ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতারাও এখন কোটিপতি। এমনকি ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ের ছাত্র ও যুব নেতারাও কোটিপতি হয়ে গেছে। অনেকের গাড়ি, বাড়ি হয়ে গেছে। অথচ তারা এখনো কর্মজীবনে প্রবেশ করে নাই। ভোট ডাকাতদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থেকে এই গোষ্ঠী শুধু যে নিজেরাই টাকাওয়ালা বনে যাচ্ছে তাই নয়। এদের অনৈতিক কার্যক্রম ও কর্মকাণ্ড দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করে দিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও এক অজানা-অচেনা গন্তব্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ছোটকালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যে বাক্যটি প্রতিনিয়ত আমাদের শেখানো হতো; “লেখাপড়া করে যে, গাড়ি-ঘোড়ায় চড়ে সে”- সেই প্রবাদটি বাংলাদেশের বর্তমান সমাজে আর কার্যকর বলে মনে হয় না। তাহলে স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে; গত দশকে দেশে কি আরও বহুমাত্রিক সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এর সোজাসাপটা উত্তর অবশ্যই। বর্তমানে সবকিছুই এখন বিভিন্ন সিন্ডিকেট সদস্যদের দখলে। তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠে, কারা এসব সিন্ডিকেটের সদস্য। কারা এসব সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। চিন্তা করে সময়ের অপচয় করার প্রয়োজন নেই। এদিক-সেদিক একটু তাকালেই সহজেই উত্তর পেয়ে যাবেন।

বর্তমানে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, জমি দখল, উন্নয়ন প্রকল্প ও সামাজিক বেষ্টনীর আওতায় বিভিন্ন কার্যক্রম থেকে চুরি, অনৈতিক ও অবৈধ আয়, খাজনা খোঁজা (জবহঃ ঝববশরহম) বা হাটে-ঘাটে-মহল্লায় চাঁদাবাজি, অর্থাৎ বাংলাদেশে বর্তমানে যারা লুটপাট ও চুরির সঙ্গে জড়িত, তাদের সবাই শাসক দলের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের প্রভাবশালী নেতা, সদস্য ও সমর্থক। সেই সঙ্গে আজকাল যোগ হয়েছে ভোট ডাকাতির মাধ্যমে, তথাকথিত নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং অনির্বাচিত দল ও দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী বা অভিজাত্যের প্রতীক আমলারা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি অংশও এদের অন্তর্ভুক্ত।

গত দশকে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে একেবারেই গ্রাম থেকে রাজধানী শহর পর্যন্ত এধরনের হাজার হাজার গোষ্ঠী (সিন্ডিকেট) জন্মলাভ করেছে। যেমন; আমলাদের সিন্ডিকেট, আমলাদের নেতৃত্বে ঠিকাদারদের সিন্ডিকেট, বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতায় ব্যাংক লুটেরাদের সিন্ডিকেট, সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জের সহযোগিতায় শেয়ারবাজার লুটেরাদের সিন্ডিকেট, এমনকি খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের যোগসাজশে ও তত্ত্বাবধানে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনে বিনিময় হার সাব্যস্ত করার সিন্ডিকেট, জনগণকে সাজানো ও বিকৃত পরিসংখ্যান দিয়ে মিথ্যা তথ্য সরবরাহে মন্ত্রী ও আমলাদের সিন্ডিকেট, নির্বাচন কমিশনের নেতৃত্বে ভোটাধিকার হরণে ভোট ডাকাতদের সিন্ডিকেট, সরকারদলীয় নেতার নেতৃত্বে সংসদ নির্বাচনে সরকারি দল ও গৃহপালিত বিরোধী দলের আসন ভাগাভাগির সিন্ডিকেট, স্বাস্থ্য বিভাগের নেতৃত্বে সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থাকা ডাক্তার নেতাদের নেতৃত্বে প্রাণ বাঁচানো হার্টের রিং বিক্রেতাদের সিন্ডিকেট, ক্যান্সার, কিডনি, লিভার সিরোসিসের ভুয়া রোগী সাজিয়ে সরকারি অনুদানের টাকা আত্মসাতের সিন্ডিকেট (কালবেলা-১৮/১২/২৩), সরকারি হাসপাতালে বিছানা ও ওষুধ পাওয়ার জন্য মধ্যস্থতাকারীদের সিন্ডিকেট, চোখের লেন্সের ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট, সরকার সমর্থিত নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যে যেমন; চিনি, ভোজ্য তেল, গম আমদানিকারকদের সিন্ডিকেট, প্রণোদনার নামে কৃষকদের নিম্নমানের বীজ ও সার সরবরাহে এবং কৃষি যন্ত্রপাতিতে ভর্তুকি দেয়ার নামে চুরির সিন্ডিকেট, সরকার সমর্থিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের সিন্ডিকেট, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সিন্ডিকেট, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের নেতৃত্বে মেধার পরিবর্তে দলীয় লোকদের সরকারি চাকরিতে নিয়োগের সিন্ডিকেট, মানবাধিকার কমিশনের নেতৃত্বে মানবাধিকার হরণের সিন্ডিকেট, এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের নেতৃত্বে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সঞ্চালনে সরকারি কোম্পানিগুলোর সিন্ডিকেট, সিস্টেম লস (System Loss) বলে পাইপ লাইন থেকে গ্যাস চুরি ও মিথ্যা বিল বানানোর সিন্ডিকেট, রেজিস্ট্রি অফিসে জমি ক্রয়-বিক্রয়ে সিন্ডিকেট, বিদেশে লোক পাঠানোর সিন্ডিকেট, পাসপোর্ট অফিসে দালালদের সিন্ডিকেট, দুদকের নেতৃত্বে বিরোধীদের হেনস্তা করা এবং সরকার সমর্থিতদের জন্য সমাজকে দুর্নীতির অভয়ারণ্যে পরিণত করার সিন্ডিকেট, চর দখল ও বালুমহাল থেকে বালু চুরির সিন্ডিকেট, দুর্নীতিবাজ আমলাদের পদোন্নতি ও লোভনীয় পদ ও স্থানে পোস্টিং দেয়ার সিন্ডিকেট, কে কোন রাস্তায় (রুট) বাস চালাবে ও ভাড়া কতো হবে সেটা নির্ধারণে পরিবহন খাতে সরকার সমর্থিত মালিকদের সিন্ডিকেট। খাতওয়ারি এরকম হাজারো সিন্ডিকেট সৃষ্টি হয়েছে। এসব সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে আছে সরকারদলীয় রাজনীতিবিদ, বিনা ভোটের সংসদ সদস্য, দুর্নীতিবাজ ও দলবাজ আমলারা। এমন গোষ্ঠীর সদস্যরা একে অপরের সঙ্গে যোগসাজশ করে, অবাধে দুর্নীতির মাধ্যমে জনগণের সম্পদ লুটপাট করে যাচ্ছে।

দুর্নীতি সব দেশেই কম-বেশি আছে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। বাংলাদেশেও সবসময়, সব সরকারের আমলেই ছিল। কিন্তু এমন নির্লজ্জের মতো প্রকাশ্য দিবালোকে ডাকাতির মতো চুরি, এর আগে আমাদের সমাজে আর কখনো দেখা যায়নি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় বর্তমানে দেশের সরকারি কর্মকর্তারা (নির্বাচিত, অনির্বাচিত ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য) লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে ফেলেছেন। দুর্নীতির মাধ্যমে লুটপাটকে এসব গোষ্ঠী সমাজের ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সচরাচর রীতিনীতি ও প্রথা বানিয়ে ফেলেছেন। এসব গোষ্ঠী শুধু যে ব্যবসা-বাণিজ্য অঙ্গনে আধিপত্য বিস্তার করে আছেন, তাই নয়। তারা একই ধরনের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছেন দেশের প্রতিটি সাংবিধানিক ও আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অঙ্গনে। ফলে দেশের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো আজ দেউলিয়া হয়ে গেছে। এসব ফাঁক-ফোকরে পড়ে প্রকৃত ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ জপ করতে করতে ব্যবসা ছেড়ে পালিয়ে যাবার রাস্তা খুঁজছেন। অনেকেই ব্যবসা ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। অনেকেই ঋণভারে জর্জরিত হয়ে চাপা উত্তেজনার পীড়নে অকালে মৃত্যুবরণ করছেন।

এক কথায় বলতে হয় যে, দেশের অর্থনীতিতে এমন কোনো খাত নেই যেখানে নতুন নতুন সিন্ডিকেট সৃষ্টি হয়নি। এরকম খাতওয়ারি সিন্ডিকেট একেবারে গ্রাম পর্যায় থেকে উপজেলা হয়ে স্তরে স্তরে কেন্দ্র পর্যন্ত বিস্তৃত। এসব সিন্ডিকেটের সদস্যরা সরকারদলীয় নেতা। তারা একে অপরের যোগসাজশে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ব্যাংক লুট, নদী থেকে বালু লুট, ইটভাটার জন্য বেআইনিভাবে জমির উপরস্থ উর্বর মাটি চুরি, নদী দখল, চর দখল, সরকারি গুদাম থেকে সার ও খাদ্য লুট, মুদ্রা পাচার ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ উপায়ে অর্থ অর্জন বা লুটপাটে সদা-সর্বদা ব্যস্ত। উপার্জন অবৈধ, তাই ভ্যাট ও ট্যাক্স ফাঁকি দেয়া যায়। দিলেও যৎসামান্য। এই গোষ্ঠী বাংলাদেশে বর্তমানে একে অপরের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে। এই গোষ্ঠীকে যদি কেউ লুটপাটের সিন্ডিকেট হিসেবে চিহ্নিত করে তাহলে ভুল হবে না। অতএব কেবলমাত্র তেল, ডিম, পিয়াজ ও আলু বিক্রেতাদের সিন্ডিকেটের দোষ দিয়ে কি মূল্যবৃদ্ধি থামানো যাবে? মানুষের দুর্ভোগ কমানো যাবে? আমার বিশ্বাস প্রত্যেক পাঠক এই প্রশ্নের উত্তর জানেন।

রীতিনীতি প্রথার বনবাস:
এই লুটপাট ও অসাধু প্রতিযোগিতায় কোনো নৈতিকতা, সামাজিক রীতিনীতি, প্রথা বা ব্যবসায়িক মান ও প্রমিতির কোনো বালাই নেই। তাদের কাছে আইন-কানুন কোনো বিষয় নয়। কেননা, তারা সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ও আশ্রয়-প্রশ্রয়ের লোক। তাদের প্রয়োজনে বা সুবিধার্থে সরকারের সরবরাহ ও সংগ্রহ বিধিমালা (Procurement Rules and Regulations) বলদানো হয়। পাশাপাশি প্রয়োজনমাফিক বিধি-বিধান এড়িয়ে গিয়ে ব্যতিক্রমী কার্যপন্থা নির্ধারণ করতেও তাদের মুহূর্তমাত্র বিলম্ব হয় না। এমনকি সরকার তাদের সমর্থকগোষ্ঠীকে ব্যবসা দেয়ার জন্য ও ভবিষ্যতে আইনি ঝামেলা থেকে মুক্ত রাখতে, নতুন আইন পাস করতেও দ্বিধা করে না। এইসব গোষ্ঠী যেসব সরকারি দপ্তরের (department) সঙ্গে ব্যবসা করে, ওইসব দপ্তরে বা নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোতে তাদের পছন্দমতো আমলা (কর্মকর্তা) নিয়োগ দিতে পারেন। আবার প্রয়োজনমতো বা চাপের মুখে তাদের বদল করে দিতে পারেন। একই প্রথা এখন উপজেলা, জেলা ও সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও রীতিনীতি হয়ে গেছে। এসবই করা হয় সরকার সমর্থিত বায়বীয় ব্যবসায়ী এবং বিনাভোটে বা প্রহসনের মাধ্যমে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও দলবাজ সরকারি কর্মকর্তাদের অশুভ যোগসাজশে। অতএব বাংলাদেশে জনগণের বর্তমান দুঃখ-দুর্দশা বা দুর্ভোগের জন্য যদি কোনো সিন্ডিকেটকে দায়ী করতে হয়, তাহলে বাস্তবে দায়ী হলো এসব সিন্ডিকেট। খেটে খাওয়া ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা একা দায়ী নয়। ভোক্তা অধিকার কমিশনের কর্মকর্তারা ও মেজিস্ট্রেটবৃন্দ জোরপূর্বক যত জরিমানা আদায় করবেন, দাম আরও বাড়বে। সেইসঙ্গে ভোক্তাদের দুর্ভোগ আরও বাড়বে।

সিন্ডিকেটের থাবা-কোষাগার লুণ্ঠন: গত দশকে সরকারি কেনাকাটা বা সরবরাহের যেকোনো দরপত্র প্রকাশ্যে আসার আগেই সরকার সমর্থক সিন্ডিকেটের সদস্যরা একে অপরের সঙ্গে যোগসাজশে গোপন আঁতাত, ষড়যন্ত্র ও সমঝোতার মাধ্যমে ঠিক করে নেয়, কোন কাজটি কে করবে, কতো টাকায় করবে, কতো টাকা চুরি করবে এবং কে কতো পাবে। অর্থাৎ কোনো গোষ্ঠী লুটপাটের টাকার কতোটুকু অংশীদারিত্ব পাবে। এভাবেই এই গোষ্ঠী (সিন্ডিকেট) একে অপরের সঙ্গে যোগসাজশের মাধ্যমে সেবা বা সরবরাহকৃত পণ্যের মূল্য বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। নির্মাণকাজ, সেবা বা সামাজিক বেষ্টনীর আওতায় সামাজিক উন্নয়ন কার্যক্রমও তাদের লুটপাটের হাত থেকে রেহাই নেই। এ কারণে টেন্ডারের মাধ্যমে হোক বা বিনা টেন্ডারে হোক, সরবরাহকৃত পণ্য বা সেবা যা-ই হোক না কেন, একদিকে এসবের দাম বেশি, আবার অন্যদিকে অত্যন্ত নিম্নমানের। ফ্লাইওভার নির্মাণ থেকে বড় বড় সড়কের কাজ, সেতু থেকে রেলপথ, তেল দ্বারা পরিচালিত ছোট বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আনবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, গ্রামের রাস্তার মেরামত, শহরগুলোর বর্জ্য অপসারণ, বন্যা ও নদীভাঙন থেকে শহর রক্ষায় নদীশাসন কোনো কিছুই এদের আয়ত্তের বাইরে নেই।”

নদীর বাঁধ ও হাওরের বেড়িবাঁধগুলো প্রতি বছর ভেঙেপড়া ও রাস্তাঘাটের বেহাল চেহারা উদাহরণ হিসেবে নিয়ে পাঠক নিজেই বর্তমান লুটপাটের প্রকৃত অবস্থা অনুমান করে নিতে পারেন। এগুলোর জন্য কি পিয়াজ ও আলু বিক্রেতাদের সিন্ডিকেট দায়ী। খাদ্য-পণ্যের বেলায় কোনো একটা পণ্যের রাত্রে দাম বাড়লেই, সকালেই ভুক্তভোগী ভোক্তা টের পায়। বাকি সব পণ্যের দাম বাড়লেও বুঝতে কিছুদিন লেগে যায়। কারও হয়তো বোঝার প্রয়োজন নেই। কারণ ওই পণ্য কেনার সামর্থ্য নেই। তবে অর্থনীতির এক খাত, অন্য বহু খাতের সঙ্গে জড়িত। তাই এর প্রভাব-প্রক্রিয়ায় তিনি যে ভুক্তভোগী তা কোনোদিন হয়তো বুঝবেওনা। দেশের অর্থনীতিকে কাঠ-ঠোকরা পাখির মতো এই গোষ্ঠী ঠুকরে ঠুকরে গর্ত করে ফেলেছে। গর্ত যত বেশি হয়, গাছ তত দুর্বল হয়। দেশের অর্থনীতির অবস্থা এখন একই অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে।

চোরে চোরে মাসতুতো ভাই: লুটপাটের মাধ্যমে অবৈধভাবে অর্জিত এই অতিরিক্ত অর্থ সবাই মিলে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়। অন্যদিকে আবার টেন্ডারে প্রাপ্ত কাজের ওয়ার্ক অর্ডার দেখিয়ে এই লুটেরা (সিন্ডিকেট) গোষ্ঠীর সদস্যরা ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নিতে কোনো সমস্যা নেই। অনেক সময় কাজ শেষ হওয়ার আগেই, অর্থাৎ কাজ শেষ না করেও সরকারি কোষাগার থেকে পুরো টাকা উঠিয়ে নিতে কোনো বাধা নেই। পুরো টাকা উঠিয়ে নিলেও এই গোষ্ঠীর সদস্যরা ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণ পরিশোধ করার কোনো প্রয়োজন মনে করে না। অর্থাৎ একই কাজে চারদিকে লুট; প্রথম; বেশি টাকায় টেন্ডার পাওয়া। দ্বিতীয়; কমদামে নিম্নমানের উপাদান ব্যবহার করে নিম্নমানের কাজ। অর্থাৎ মান কমিয়ে খরচ কম করে লুট করা। তৃতীয়; ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া। কাজ শেষ। টাকা উঠিয়ে ফেলেছে। কিন্তু ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করার তাড়া নেই। অনেকে আবার ঋণ শোধ না করে বিদেশে পাচার করে দেয়। পাচার করা টাকা দিয়ে বিদেশে বাড়ি-গাড়ি কিনে বা বিনিয়োগ করে। মোট কথা হলো; এই লুটপাটের টাকা ব্যাংকে ফেরৎ না দিয়ে বা বিদেশে পাচার করে দিয়ে, দেশের আর্থিক খাত ও অর্থনীতিকে ভয়াবহ এক সংকটের মুখোমুখি অবস্থানে নিয়ে এসেছে।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনো এরকম পরিস্থিতি লক্ষ্য করা যায়নি। পরিণতিতে নির্মাণকাজসহ সরকারের ক্রয়কৃত ও সরবরাহ করা, সকল সেবা ও পণ্যের মান একদিকে যেমন নিম্নমানের, তেমনি অন্যদিকে মূল্য হচ্ছে আকাশচুম্বী। এ কারণেই যেকোনো নির্মাণ কাজ, পণ্য ও সেবা ক্রয় করতে সরকারের যা খরচ হওয়া উচিত, বর্তমানে তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি অর্থ ব্যয়িত হয়। বর্তমানে পুরো সরকারি ক্রয়-বিক্রয় ও সেবা প্রদানের প্রক্রিয়া “চোরে-চোরে মাসতুতো ভাই” চক্রের (সিন্ডিকেট) হাতে চলে গেছে। এখন তারা যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। এমনকি ৩০০ টাকার বালিশ ৩০০০ টাকায় কিনতেও কোনো বাধা নেই। কারণ এসবই দেশের সম্পদ লুট করার নাটক।

এই নাটক “চোরে-চোরে মাসতুতো ভাই” গোষ্ঠী দ্বারা লিখিত, (মানে টেন্ডার লিখা) অভিনীত (মানে ক্রয়-প্রক্রিয়া), পরিচালিত (মানে কাজ বুঝে নেয়ার দায়িত্ব) ও প্রযোজিত। এমনকি এই নাটকে যদি কোন গান দেখাতে হয়, তাও তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। গানের প্রযোজকও তারাই। তাদের দ্বারা প্রযোজিত ও পরিচালিত এই নাটকের দর্শকও তারা নিজেরাই। কোনো আইন এদের স্পর্শ করতে পারে না। কারণ আমাদের এই স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশে এখন আর আইনের সমপ্রয়োগ হয় না। বস্তুত আইনের শাসন বলতে যা বোঝায় তার কোনো কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। গণতন্ত্রের পরিবর্তে স্বৈরতন্ত্র চালু করার সঙ্গে সঙ্গে লুটেরাতন্ত্র যোগ করে দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির সাথে সমাজকেও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে। সেইসঙ্গে প্রিয় মাতৃৃভূমিতে আমরা এখন “আইনের শাসনের পরিবর্তে-আইন ও বিধি-বিধান দ্বারা শাসিত (Rule of Law VS Rule by Law)।”

(চলবে)
সাবেক সভাপতি, এফবিসিসিআই
কৃষি অর্থনীতিবিদ

Print Friendly, PDF & Email
 
 
জনতার আওয়াজ/আ আ
 

জনপ্রিয় সংবাদ

 

সর্বোচ্চ পঠিত সংবাদ