অসমাপ্ত বিপ্লব : এক ঘুমন্ত অগ্নিগিরি
নিজস্ব প্রতিবেদক, জনতার আওয়াজ ডটকম
প্রকাশের তারিখ:
বৃহস্পতিবার, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২৫ ৪:০০ অপরাহ্ণ পরিবর্তনের তারিখ:
বৃহস্পতিবার, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২৫ ৪:০০ অপরাহ্ণ

মারুফ কামাল খান
হাসিনা ফ্যাসিস্ট ছিলেন। তার ফ্যাসিস্ট রেজিম প্রায় ষোলো বছর ধরে চলেছে। ওই সময়ে অনেক নিরপরাধ মানুষের রক্ত ঝরেছে। বিনাবিচারে দুঃশাসন প্রাণ সংহার করেছে অনেক মানুষের। তখন ন্যায়বিচার ছিল নির্বাসিত। সত্য প্রকাশ ছিল নিষিদ্ধ। স্তাবকতা স্থান দখল করেছিল সাংবাদিকতার। পুলিশ ও প্রশাসন পরিণত হয়েছিল হাসিনার ব্যক্তিগত ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীতে। রাষ্ট্রের সব উঁচু পদে অনুগ্রহভাজন ক্রীতদাসরা অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। রাষ্ট্র পরিচালনা বলতে হাসিনা বুঝতেন অত্যাচার আর দমন-পীড়ন। মিথ্যা, প্রতারণা ও অভিনয় ছিল তার কাছে অনুসৃত রাজনীতি। রাষ্ট্রের প্রকল্পগুলোর ব্যয় কয়েকগুণ বাড়িয়ে তার বেশির ভাগ লুটে খাওয়ার নাম দেওয়া হয়েছিল উন্নয়ন। আর সেই লুটতরাজের উন্নয়নের দোহাই দিয়ে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল মানুষের সব অধিকার। আইনকানুনের ওপর অগ্রাধিকার পেত হাসিনার স্বেচ্ছাচারিতা।
Advertisement: 0:13
Close PlayerUnibots.com
হাসিনার এই অপশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর কোনো জো ছিল না। এর বিরুদ্ধে মানুষের মনে পুঞ্জীভূত হচ্ছিল ঘৃণা। বছরের পর বছর ধরে অবাধে স্বেচ্ছাচারিতা চালাতে চালাতে হাসিনার অন্তর্দৃষ্টি অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মানুষের নীরব প্রতিবাদ অনুধাবনের ক্ষমতা তিনি হারিয়ে ফেলেছিলেন। সময়ের ব্যবধানে মানুষের এই ঘৃণা জমাট বেঁধে ক্ষোভে পরিণত হয়। সেই ফুঁসে ওঠা ক্ষোভ দুর্নিবার ক্রোধ হয়ে হাসিনার ক্ষমতার সিংহাসনে আঘাত হানে। ফ্যাসিস্ট রেজিমের পতন ঘটে। হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়ে আত্মরক্ষা করেন।
দেশের অবদমিত মানুষের সেই সফল মহাবিদ্রোহের রেশ এখনও কাটেনি। সবার ধারণা ছিল, মানুষের স্মৃতিতে যতদিন হাসিনার পরিণাম ও পরিণতির কথা জাগরূক থাকবে, ততদিন অন্তত এ দেশে আর ফ্যাসিবাদ ফিরে আসবে না। সেই ধারণা কি ভুল হতে চলেছে? ফ্যাসিবাদের নিগড়ে দীর্ঘদিন বন্দি থাকতে থাকতে কি মানুষের মধ্যে ফ্যাসিবাদের বীজ সংক্রমিত হয়ে গেছে? আজ যারা সরকারে আছেন তাদের অনেকের মধ্যে, প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে, ফ্যাসিবাদবিরোধী অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের মধ্যে এবং প্রায় সব পেশাজীবী সংগঠনের মধ্যে ফ্যাসিবাদের আলামত দিনকে দিন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তাদের সবার চোখেমুখে দেখছি সেই জেদ, অহংকার, আত্মম্ভরিতা, অসহিষ্ণুতা, ঘৃণা-বিদ্বেষ ও অপকৌশলপ্রিয়তা। তাহলে কী দাঁড়াল? ফ্যাসিস্ট রেজিমের পতন হলেও ফ্যাসিবাদ গেল না? নিজেদের চরিত্রের মধ্যে ফ্যাসিবাদের বীজ জিইয়ে রেখে কি দেশে গণতন্ত্র কায়েম করা সম্ভব? আমরা একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ভোটের আয়োজন করে ফেলতে পারলেই কি সত্যিকারের গণতন্ত্র ফিরে আসবে? নাকি পেছনের দিকে পা যে ভূতের সেই ভূতের মতো আমরা গণতন্ত্রের দিকে যাত্রা করে আবারও ফ্যাসিবাদের কাছে ফিরে যাব?
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার এখন দায়িত্বে। নোবেল বিজয়ী এই গরিবের ব্যাংকার ও অর্থনীতির অধ্যাপকের দিকে তাকালে আমাদের বুক গর্বে ভরে যায়। কী তার প্রজ্ঞা ও বিনয়! মাথা নুয়ে আসে। অথচ তার পাশে দাঁড়ানো উপদেষ্টা সহকর্মীদের বেশির ভাগকেই এত বামন মনে হয় কেন? যেন সুউচ্চ পর্বতের পাদদেশে মূষিক হাঁটছে। সবার কথা বলছি না। কয়েকজন সম্মানজনক ব্যতিক্রম আছেন। আর বাদবাকিদের এমনই যোগ্যতা যে, তারা কথা বলার জন্য মুখ খুললেই ‘ফাউল’ হয়ে যায়। আর তাদের পারফরম্যান্স তো মাশাআল্লাহ? প্রতি পদেই জগাখিচুড়ি। অথচ একেক জনের সে কী দর্প! দু’দিনের এই বৈরাগীরা ভাতকে পঞ্চমুখে অন্ন বলে যাচ্ছেন। এরা কোন? যোগ্যতায় এখানে এসেছেন তা তারা নিজেরাও জানেন না। আর কারও কাছে জবাবদিহি করতে হয় না বলে তারা ধরেই নিয়েছেন যে, তারা যা করছেন তাই বিশ্বসেরা।
যে সরকারে অযোগ্যদের এতটা সংখ্যাধিক্য সেই সরকারের সহায়তায় দক্ষ, যোগ্য, উপযুক্ত ও মেধাবী সব কর্মকর্তা নিযুক্ত করা অত্যাবশ্যক ছিল। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও লবডঙ্কা। গত কয়েক মাসে যাদের সরকারের নানা অঙ্গনে পদায়ন ও নিয়োগ করা হয়েছে তাদের লিস্টিটা দেখেন। আবারও সেই একই প্রশ্ন তুলতে হয়, হাতে গোনা গুটিকয় সম্মানজনক ব্যতিক্রম বাদ দিলে বাকিরা কারা? সেই স্তাবকের দল, অনুগ্রহভাজন ও অযোগ্য চামচাদের বসিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রায় সবখানে। এনার-উনার চেনাজানা ছাড়া আর কী যোগ্যতায় ওদের বেছে নেওয়া হয়েছে, সে প্রশ্নের সুষ্ঠু জবাব মিলবে না। কর্তাদের মনোরঞ্জন ছাড়া এদের আর তেমন কিছু করার যোগ্যতাই নেই। শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশাগত দক্ষতা এবং অন্যান্য ব্যাকগ্রাউন্ড খুঁজতে গেলে ওদের ভাঁড়ারে ছুঁচোর কেত্তন ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না। হরি হে দীনবন্ধু! তাইতো অন্তর্বর্তী সরকারের পারফরম্যান্সের এমন বেহাল। ছাগল দিয়ে হালচাষ করলে যেমন ফসল ফলার কথা, তাই ফলছে। খালি ইউনূস সাহেবের ধারে ও ভারে কিছুটা কাটছে বলে অন্তর্বর্তী সরকার এখনও পুরো দেউলিয়া হয়ে পড়েনি। দয়ার শরীর প্রধান উপদেষ্টার প্রতি আবারও করজোড়ে মিনতি করি, গতিক কিন্তু খুব সুবিধার নয় স্যার । তবে সময় এখনও ফুরিয়ে যায়নি। আপনি দয়া করে শক্ত হোন। অনেক হয়েছে। জড় ও ক্লীবদের বোঝা বয়ে আপনি নিজের জীবনীশক্তি ক্ষয় করবেন না। অচল মাল ও আগাছা ঝেঁটিয়ে তাড়ান। আপনার সুনাম, খ্যাতি, গ্রহণযোগ্যতা ও আন্তর্জাতিক ইমেজ কিন্তু আমাদের জন্য রত্নদ্বীপ। ওতে যেন ভাঙন না ধরে।
আচ্ছা অন্তর্বর্তী সরকারের কথা আপাতত থাক- তারা তো আর খুব বেশিদিন থাকবে না। ভোট হবে, আসবে নয়া রাজনৈতিক সরকার। কিন্তু হাসিনার ফ্যাসিস্ট রেজিম পতনের পর রাজনৈতিক দলগুলোর যে চেহারা দেখছি তাতে তো তাদের ব্যাপারেও খুব বেশি আশাবাদী হতে পারছি না। প্রতি পদক্ষেপে তারা অসহিষ্ণুতা, অস্থিরতা, স্বার্থপরতা ও সংকীর্ণতার প্রমাণ দিয়ে চলেছে। হিংসুটে রাজনীতিকরা ‘ওন্দা বিলাই’য়ের মতো দাঁতমুখ খিঁচিয়ে পরস্পরের দিকে নখর বিস্তার করে ঝগড়ায় লিপ্ত হচ্ছেন। মেধা, যোগ্যতা, প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিদীপ্ততার কোনো আভাস নেই তাদের কথা ও কাজে। এতদিনের জুলুম ও এত বড় অভ্যুত্থান তাদের চিন্তায় কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি। সময়ের পরিবর্তন সত্ত্বেও যারা নিজেরাই একটুও বদলাননি, দেশ তাদের হাতে বদলাবে কেমন করে? যে ছাত্রদের আমরা নতুন আশার আলো বলে মনে করেছিলাম, তারাও তো সেই আলোর মশাল হয়ে থাকতে পারছে না। তাদের ঔজ্জ্বল্য ক্রমেই ম্লান হয়ে আসছে। তাই হাসিনা রেজিমের পতনে উচ্ছ্বসিত সবার মনেই আজ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, ফ্যাসিবাদের পতন হলেও তার ছায়া কেন এখনও রয়ে গেল?
বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদী রেজিমের পতন ঘটলেও সমাজ কিন্তু এখওা মুক্ত হয়নি। দীর্ঘদিনের দমন-পীড়নের ফলে এক ধরনের মানসিকতা সমাজের গভীরে প্রোথিত হয়েছে, যা এখনও আমাদের আচরণ, চিন্তাভাবনা ও রাজনীতিতে প্রতিফলিত হচ্ছে। এটা যেন এক ধরনের ‘ফ্যাসিবাদ-পরবর্তী ফ্যাসিবাদ’, যেখানে ক্ষমতার কেন্দ্র বদলালেও ক্ষমতার কাঠামো ও মনস্তত্ত্ব বদলায়নি। কারণ ফ্যাসিবাদ মানে শুধু কোনো এক স্বৈরশাসকের ক্ষমতা নয়; এটি এমন এক মানসিকতা, যা ধীরে ধীরে সমাজে সংক্রমিত হয়। দীর্ঘ সময় ধরে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কাঠামো একনায়কত্ব, ভীতি, তোষামোদ ও নিপীড়নের ওপর দাঁড়িয়ে থাকলে সাধারণ মানুষও তা স্বাভাবিক বলে মেনে নেয়। তারা ধাতস্ত হয়ে পড়ে। যে শিশু ফ্যাসিবাদের মধ্যে বড় হয়, সে গণতন্ত্রের অর্থ জানবেই বা কীভাবে? এ কারণে দেখা যায়, যারা একসময় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিল, তারাও ক্ষমতায় গেলে স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ করে। তারা বিরোধীদের দমন করতে চায়, মুক্তচিন্তার জায়গা সংকুচিত করতে চায় এবং বিরোধী কণ্ঠকে সহ্য করতে পারে না। অর্থাৎ ক্ষমতার পরিবর্তন হলেও রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলায় না। কাজেই ফ্যাসিবাদী রেজিমের পতন মানেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নয়। প্রকৃত স্বাধীনতা তখনই আসে, যখন মানুষ নিজের মধ্যে গেড়ে বসা ফ্যাসিবাদী মানসিকতা থেকে মুক্ত হতে পারে। অন্যথায় আজকের মুক্তিযোদ্ধারাই কালকের অত্যাচারী হয়ে উঠতে পারে। তাই হাসিনা রেজিমের পতনের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই শেষ হয়নি, বরং এখনই এর শিকড় উপড়ে ফেলার সময়। তবে এখনকার সময়টাকে আমরা ফ্যাসিবাদের শেকড় উপড়ানোর কাজে লাগাতে পারব কিনা তা আমি এই মুহূর্তে নিশ্চিত করে বলতে পারব না। তবে আমি হতাশ নই। আমি শুধু বাস্তব চিত্রটা তুলে ধরলাম যাতে আমরা বাস্তবতার দিকে চোখ ঠেরে পরিস্থিতির ভুল মূল্যায়ন করে না বসি। একই সঙ্গে আমি নিশ্চিত যে, আজ না হলেও ফ্যাসিবাদের শেকড় উপড়ে ফেলে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কায়েমের দিন আসবেই।
অকল্পনীয় দ্রুততায় হাসিনার ফ্যাসিস্ট রেজিম পতনের উল্লাসে ছাত্র-গণ-অভ্যুত্থানে যতিচিহ্ন পড়ে। এতে সেই সাবেকি ও কায়েমি ব্যবস্থাই ফের কর্তৃত্ব দখল করে নেয়। ফলে আর বিপ্লব সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। কাজেই চব্বিশের বিজয় হয়ে আছে এক অসমাপ্ত বিপ্লব। এই আনফিনিশড রেভল্যুশন যে অস্থিরতার জন্ম দিয়েছে সে অস্থিরতা সহসা থামবে না। একটি নির্বাচন দিয়ে এর সুরাহা হবে না। বিপ্লব সম্পন্ন করতে হবে। অতি চাতুরী করে কায়েমি রাজনীতি বিপ্লবের ঘোষণা ও কর্মসূচি থামিয়ে দিয়ে অসমাপ্ত বিপ্লবকে এক ঘুমন্ত অগ্নিগিরি বানিয়ে রেখেছে। এই পরিস্থিতি সমাজের স্থিতি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে থাকবে। চব্বিশের বিপ্লবের প্রজন্মকে এই বিপ্লব সম্পন্ন করতে না দিলে তারা ট্র?্যাক থেকে সরে যাবে। রিলে রেসের মতো আসবে পরবর্তী অগ্রণী দল। তারা বিপ্লবী পথেই আনবে নয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্ত, গঠন করবে নয়া রিপাবলিক। এর অন্যথা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আবু সাঈদ, শান্ত, ওয়াসিম, সাকিব, তামিম, ইয়ামিন, তানভিন, ফাইয়াজ, মুগ্ধ, রুদ্র, শাকিল, নাঈমা, সুমাইয়াসহ হাজারো শহীদ যে বিপ্লবের সূচনা করে গেছেন, তা চূড়ান্ত গন্তব্যে পৌঁছাবেই। ওদের উদ্দেশে বলি :
ওরা দু’পায়ে দ’লে গেল মরণ-শঙ্কারে
সবারে ডেকে গেল শিকল ঝঙ্কারে,
বাজিল নভ-তলে স্বাধীন ডঙ্কা রে,
বিজয়-সঙ্গীত বন্দী গেয়ে চলে
বন্দীশালা মাঝে ঝঞ্ঝা প’শেছে রে
উতল কলরোলে।
মারুফ কামাল খান : সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক
জনতার আওয়াজ/আ আ
