কারফিউ জারি হলো কেন, সহিংসতা ঠেকাতে এটাই কি শেষ সমাধান? - জনতার আওয়াজ
  • আজ সন্ধ্যা ৬:১০, বুধবার, ১৪ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৩১শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১৬ই জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি
  • jonotarawaz24@gmail.com
  • ঢাকা, বাংলাদেশ

কারফিউ জারি হলো কেন, সহিংসতা ঠেকাতে এটাই কি শেষ সমাধান?

নিজস্ব প্রতিবেদক, জনতার আওয়াজ ডটকম
প্রকাশের তারিখ: শনিবার, জুলাই ২০, ২০২৪ ৮:০৭ অপরাহ্ণ পরিবর্তনের তারিখ: শনিবার, জুলাই ২০, ২০২৪ ৮:১০ অপরাহ্ণ

 

জনতার আওয়াজ ডেস্ক
কোটা বিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভকারীদের সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কর্মীদের নজিরবিহীন সংঘাত যেন থামছেই না। কোন আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এতো কম সময়ের মধ্যে একশোর বেশি মানুষ নিহত হবার ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনো ঘটেনি।

বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিংবা সহিংসতা নিয়ন্ত্রণের জন্য কারফিউ জারি করা নতুন কোন বিষয় নয়। সহিংসতা যখন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে যায় তখন তা নিয়ন্ত্রণের সর্বশেষ উপায় হিসেবে কারফিউ বিবেচনা করে সরকার।

সর্বশেষ কারফিউ জারি করার ঘটনা ঘটেছিল ২০০৭ সালে সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। সেটিও হয়েছিল ছাত্র বিক্ষোভ দমনের জন্য।

গত মঙ্গলবার থেকে শুরু করে শুক্রবার পর্যন্ত দেশজুড়ে নজিরবিহীন এই সংঘাত শুধু তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। প্রতিদিনই বেড়েছে মৃত্যুর সংখ্যা।

প্রথম দিন শুধু পুলিশ মাঠে থাকলেও এক পর্যায়ে তাদের সহায়তা করার জন্য সীমান্ত-রক্ষী বাহিনী বিজিবি নামানো হয়। তাতেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। এরপরে কারফিউ জারি করে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।

কারফিউ জারি করতে হলো কেন?
কারফিউ এমন এক সময়ে জারি করা হলো যখন পুলিশ, র‍্যাব এবং বিজিবির সাথে বিক্ষোভকারীদের রক্তাক্ত সংঘাত হয়েছে টানা চারদিন ধরে। নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কি এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয়েছে?

“এক অর্থে তো হয়েছেই। যেখানে বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবন দখল করলো দুষ্কৃতিকারীরা। পুলিশ, বিজিবি সেটা ঠেকাতে পারলো না। এটা তো বড় ধরনের ব্যত্যয় বলে আমি মনে করি,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন সাবেক পুলিশ প্রধান একেএম শহিদুল হক।

তবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক মনে করছেন, রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যর্থ হয়নি। বিবিসি বাংলাকে তিনি জানিয়েছেন, চলমান সহিংসতা থামানো এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো রক্ষা করার জন্য সরকার কারফিউ দিতে বাধ্য হয়েছে।

“সেজন্যই বলা হয়েছে ইন এইড অব সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায়)। তারা মোটেও ব্যর্থ হয় নাই। আমাদের কথা হচ্ছে, যেভাবে তারা কেপিআইগুলো (গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা) ধ্বংস করেছে এবং জনগণের ট্যাক্স-এর টাকায় যেসব স্থাপনা বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য করা হয়েছে, সেগুলো ধ্বংস করার চেষ্টা করা হচ্ছে, সেগুলোকে রক্ষা করার জন্য আমরা এটা (কারফিউ) দিতে বাধ্য হয়েছি,” বিবিসি বাংলাকে বলেন আইনমন্ত্রী।

আইনমন্ত্রী বলছেন, যারা কোটা বিরোধী আন্দোলন করছে তারা এই সহিংসতার সাথে সম্পৃক্ত নয়। তারা এটা পরিষ্কারভাবে এই কথা জানিয়ে দিয়েছে। আমাদের কাছে আরো পরিষ্কার হয়েছে যে এটা কিছু রাজনৈতিক দলের সন্ত্রাসীরা তাদের নেতাদের উস্কানিতে করছে।

“সহিংসতা বন্ধ করার জন্য এবং জনগণের জানমাল রক্ষা করার জন্য যেটা করার দরকার আমরা সেটা করেছি। আমরা আশা করছি কারফিউ দিয়ে এই সমস্যার সমাধান করতে পারবো,” বলেন আইনমন্ত্রী।

অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার এম সাখাওয়াত হোসেন মনে করেন, গত কয়েকদিনের সংঘাতের কারণে সরকারের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়েছে।

“এতো পুলিশ, এতো র‍্যাব, এতো বিজিবি – সব নামানোর পরেও সরকার যেহেতু নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি, সেজন্য কারফিউ জারি করা হয়েছে বলে আমি মনে করি,” বলেন তিনি।

কোটা বিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এবার অভাবনীয় এক পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন, সহিংসতা যখন কয়েকটি জায়গার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে তখন পুলিশের জন্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়। কিন্তু সংঘাত যখন বিভিন্ন জায়গায় এবং অলিগলিতে ছড়িয়ে যায়, তখন সেটির মোকাবেলা করা পুলিশের জন্য কঠিন হয়ে ওঠে।

সাবেক আইজিপি একেএম শহিদুল হক বলছেন, “পুরো বাংলাদেশে শহরের আনাচে-কানাচে যেভাবে আন্দোলনের নামে দুর্বৃত্তরা ছড়িয়ে পড়ে, পুলিশ কেমনে পারবে? এতো এতো পুলিশ কোথায় পাবে? পুলিশের সংখ্যা তো সীমিত। এটা সম্ভব নাকি?”

“সব জায়গায় একসাথে- উত্তরা, রামপুরা, বাড্ডা, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী – কোথায় সহিংসতা হয় নাই? এতো পুলিশ কোথায় পাবে? ”

শুক্রবার ঢাকার আকাশে ক্রমাগত হেলিকপ্টার চক্কর দিয়েছে। যেসব এলাকায় বিক্ষোভের তীব্রতা বেশি ছিল সেসব জায়গায় হেলিকপ্টার থেকে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করা হয়েছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছিলেন।

বিগ্রেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন এই ঘটনাকে অস্বাভাবিক বলে বর্ণনা করছেন।

তিনি প্রশ্ন তুলছেন, “হেলিকপ্টার থেকে টিয়ারশেল মারা হয়েছে। এটা কি স্বাভাবিক বিষয়? সরকারের হাতে থাকা সব ইন্সট্রুমেন্ট ব্যবহার করার করার পরেও যখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তখন কারফিউ জারি করে সেনাবাহিনী নামানো হয়। ”

কারফিউ কি শেষ পদক্ষেপ?
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, চলমান সহিংসতা থামানো এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো রক্ষা করার জন্য সরকার কারফিউ দিতে বাধ্য হয়েছে।

তিনি বলেছেন, “সহিংসতা বন্ধ করার জন্য এবং জনগণের জানমাল রক্ষা করার জন্য যেটা করার দরকার আমরা সেটা করেছি। আমরা আশা করছি কারফিউ দিয়ে এই সমস্যার সমাধান করতে পারবো। ”

পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, বিক্ষোভ দমনের জন্য কারফিউ জারি করে সেনাবাহিনী নামানো সর্বশেষ পদক্ষেপ। এরপর আর কোন পদক্ষেপ বাকি থাকে না।

সাবেক পুলিশ প্রধান শহিদুল হক বলছেন, “এটাই সর্বশেষ উপায়। কারফিউ দেয়ার অর্থ হচ্ছে জনগণকে বলা যে ‘তোমরা ঘরে থাক, বিনা প্রয়োজনে বাইরে আসবা না’। কারফিউ দিলে আইনমান্যকারী জনগণ ভেতরে থাকবে। যারা কারফিউ অমান্য করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

“এটাই সর্বশেষ। আর কী করার আছে? এটা ছাড়া তো আর কোন হাতিয়ার নেই। ”

বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধরনের পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হলে যারা সহিংসতা করতে চায় তাদের ওপর সেটি মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব তৈরি করে।

কারফিউ খুব স্বল্প সময়ের জন্য জারি করা হয়। বাংলাদেশে অতীতে বিভিন্ন সময় দেখা গেছে কারফিউ দুই থেকে তিন দিনের বেশি ছিল না। একেক সময় একেক প্রেক্ষাপটে জারি করা হয়েছিল।

“এর চেয়ে বেশি আর তো কোন ফোর্স নেই,” বলেন সাখাওয়াত হোসেন।

রাজনৈতিক সহিংসতার প্রেক্ষাপটে ২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারি যখন সেনাবাহিনীর সমর্থন নিয়ে নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয় তখন কারফিউ জারি করে পরিস্থিতি সামাল দেয়া হয়েছিল। সেই কারফিউ বলবৎ ছিল দুই দিন।

“তখন কারফিউ কাজ করেছিল। তখন জনগণ সেটা সমর্থন দিয়েছিল। এর মাধ্যমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছিল,” বলেন তিনি।

কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে এই বিক্ষোভে সরকার যে বিচলিত হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হবার পর থেকে কোন বিক্ষোভ কিংবা সহিংসতা নিয়ন্ত্রণের জন্য কারফিউ জারি করতে হয়নি।

অতীতে যখন কারফিউ জারি করা হয়েছিল, তখন দেখা গিয়েছিল যে পরিস্থিতির উন্নতি হলেও সেটি ধীরে ধীরে প্রত্যাহার করা হয়। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, চরম সংঘাতময় পরিস্থিতিতে কারফিউ জারি করা হলে সেটি সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের নিরাপত্তা বোধ তৈরি করে। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি নির্ভর করছে সাধারণ মানুষ বিষয়টিকে কীভাবে গ্রহণ করে তার ওপর।

কারফিউর সময় জরুরি সেবা সংশ্লিষ্ট অফিস ছাড়া বাকি সবকিছু বন্ধ থাকে। কারফিউর মেয়াদ যত বাড়তে থাকে তার সাথে অর্থনৈতিক ক্ষতিও বাড়ে পাল্লা দিয়ে।

“কারফিউ দীর্ঘায়িত হলে তো সরকারের ক্ষতি। সবকিছু তো বন্ধ থাকে,” বলছিলেন সাবেক পুলিশ প্রধান শহিদুল হক।

কারফিউ জারি করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে শনিবার ভোররাতে কোটা-বিরোধী আন্দোলনকারীদের সাথে বৈঠক করেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী এবং তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক শনিবার সকালে বিবিসি বাংলাকে বলেন, কোটা বিরোধী আন্দোলনের কয়েকজন সমন্বয়কের সাথে ভোর রাতে কোন আলোচনা হয়নি। আন্দোলনকারীরা তাদের দাবি পেশ করতে এসেছিল বলে তিনি উল্লেখ করেন।

“ওরা আমাদের কাছে দাবি পেশ করেছে। আমরা দাবিটা নিয়েছি। কোটা সংস্কারের ব্যাপারে যে কথা বলছে এবং যে পার্সেন্টেজ-এর কথা বলছে সেটা আমরা দেখেছি। তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের মনে হয়েছে, এটার একটা যৌক্তিক সমাধানে আসা সম্ভব,” বলেন আইনমন্ত্রী।

কারফিউ জারি এবং সেনা মোতায়েনের পর শনিবার দুপুর পর্যন্ত পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছে। যদিও ঢাকার কয়েকটি জায়গায় পুলিশের সাথে সংঘাতের খবর পাওয়া গেছে। কিন্তু সেটির তীব্রতা বৃহস্পতিবার এবং শুক্রবারের মতো ছিল না।

কারফিউ জারি করা হলেও পরিস্থিতি দীর্ঘমেয়াদে কতটা শান্ত হবে সেদিকে দৃষ্টি থাকবে অনেকের।

“এখন যে কারফিউ জারি করা হয়েছে, এর মাধ্যমে কি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে? হয়তো সাময়িক স্বস্তি আসতে পারে। কিন্তু বিষয়টা তো আর শুধু ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই,” বলেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক সাখাওয়াত হোসেন।

এদিকে কারফিউ ভঙ্গ করা হলে সেটির শাস্তি সম্পর্কে মনে করিয়ে দিচ্ছে পুলিশ। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ বলছে, জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ কারফিউ আইন ভঙ্গ করে বাইরে আসলে, তার এক বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। সূত্রঃ বিবিসি বাংলা

Print Friendly, PDF & Email
 
 
জনতার আওয়াজ/আ আ
 

জনপ্রিয় সংবাদ

 

সর্বোচ্চ পঠিত সংবাদ