ক্ষমতাসীনদের দুর্বৃত্তায়নে সঙ্কটে দেশ – জনতার আওয়াজ
  • আজ সকাল ১১:০৩, শুক্রবার, ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৫ হিজরি
  • jonotarawaz24@gmail.com
  • ঢাকা, বাংলাদেশ

ক্ষমতাসীনদের দুর্বৃত্তায়নে সঙ্কটে দেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক, জনতার আওয়াজ ডটকম
প্রকাশের তারিখ: সোমবার, সেপ্টেম্বর ৪, ২০২৩ ৫:৩৬ অপরাহ্ণ পরিবর্তনের তারিখ: সোমবার, সেপ্টেম্বর ৪, ২০২৩ ৫:৩৬ অপরাহ্ণ

 

মু. আতাউর রহমান সরকার
জোর যার মুল্লুক তার বা মগের মুল্লুক বললে সবাই সহজে বুঝে নেয় যে, ‘বিচার ও অধিকার’ যেখানে অকার্যকর। দেশে নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে এর প্রায়োগিক চিত্র ফুটে উঠছে। মানবতা, সহমর্মিতা, সহনশীলতা কিংবা সম্প্রীতির লেশমাত্র মুছে যাচ্ছে। রাজনীতি ঘিরে সামাজিক বিভেদ সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁচ্ছে যাচ্ছে। পরমত সহ্য করার মানসিকতা শূন্যের কোঠায়। যেখানে সামাজিক দায়বদ্ধতা, পারস্পরিক বন্ধন, অধিকারচর্চার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো চাপা পড়ে যাচ্ছে। ফলত, বিশৃঙ্খলা, অবিশ্বাস, আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বার্থপরতা এক শ্রেণীর মানুষের মৌলিক দোষকে সবাই বৈধ বলেই মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। আর এই সব কিছুরই মূলে ভূমিকা রাখছে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কৌশল।

বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক উত্তাপ সর্বমহলে ছড়িয়েছে। বিদেশী মিশন ও সংস্থাগুলোও এই নির্বাচন ঘিরে তৎপর হয়ে উঠেছে। তবে সবার আশঙ্কা ও চাওয়া হলো বাংলাদেশে সুশাসন ও সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন সম্পন্ন করা। সবার মানবাধিকার, মৌলিক অধিকারের সুরক্ষার বিষয়ে জোর দিয়েছে ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের সব শক্তি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিরোধী রাজনীতিকরা ব্যাপক নিপীড়ন, হত্যা, হামলা-মামলা ও উচ্ছেদের শিকার হয়েছেন। সবচেয়ে বেশি নিপীড়ন চালানো হয়েছে জামায়াতের নেতাকর্মীদের ওপর। গত ১৪ বছরের শাসনামলে সরকার দলটির অনেক নেতাকে আর্থিক ও শারীরিকভাবে করেছে পঙ্গু, করেছে এলাকা ছাড়া। এমনকি হয়রানিমূলক মামলা ও গ্রেফতারে তারা পর্যুদস্ত। দলটি এসব বিষয়ে রাজপথে প্রতিবাদের পাশাপাশি নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তি, প্রচার মাধ্যম, সামাজিক মাধ্যমে তা তুলে ধরার চেষ্টা করে আসছে।

স¤প্রতি রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় দলটির নেতাকর্মীরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ব্যাপক গ্রেফতার ও মামলায় জড়ানোর অভিযোগ করছে। এমনকি ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা তাদের বাসা ও অফিসের সামনে থেকে ধরে পুলিশকে দিচ্ছে যা রাষ্ট্রকে ডিপ স্টেটে রূপান্তরের সর্বোচ্চ সীমা বলে মনে হচ্ছে। দলটির পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো কয়েকটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি, সামাজিক মাধ্যমে দাবি করেছে যে, চলতি বছরের ৫ মে সোনালিবাগের বাসায় যাওয়ার পর ছাত্রলীগের সভাপতি নুরউদ্দিন অপুর নেতৃত্বে একদল সাদা পোশাকধারী ব্যক্তি হাতিরঝিল থানা পশ্চিম আমির ইউসুফ আলী মোল্লার বাসায় অন্যায়ভাবে আটক করে নিয়ে গিয়ে তা অস্বীকার করে। তাকে দু’দিন গুম রেখে ৭ মে হাতিরঝিল থানার ২০২২ সালের পুরনো একটি মামলায় (হাতিরঝিল ৫০ (১২)২২) গ্রেফতার দেখায়। আরেকটি অভিযোগে তারা দাবি করে, গত ৯ জুন বেলা ২টার দিকে কাজী শামসুল হুদাকে কর্মস্থলে অফিস চলাকালীন ছাত্রলীগ সভাপতি নুরউদ্দিন অপু ও হাতিরঝিল থানার এসআই আসাদ সরাসরি ক্লাসরুমে ঢুকে তাকে তুলে থানায় নিয়ে গ্রেফতার দেখানো হয়। তিনিও কোনো মালার এজাহারভুক্ত আসামি নন বলে দাবি তাদের।

সরকারদলীয় নেতারা যে দুর্বৃত্তসুলভ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন তা এসব ঘটনা থেকে বলা যেতেই পারে। কারণ আইনশৃঙ্খলা সংশ্লিষ্ট কাজ করার জন্য পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনী নিয়োজিত আছে। ছাত্রলীগের প্রতিপক্ষ ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদের ওপরও তারা হামলে পড়েছে বলে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশের ইসলামী ধারার ছাত্র সংগঠনটি। তাদের দাবি অনুযায়ী, এ বছরের ১৯ জুন রাত সাড়ে ১০টায় নয়াটোলা, আইডিয়াল পয়েন্টের সামনে তার বাসার নিচ থেকে ছাত্রশিবিরের হাতিরঝিল থানা সভাপতি মাকসুদুর রহমানকে ছাত্রলীগের সভাপতি নুরউদ্দিন অপুর নেতৃত্বে তুলে থানায় নিয়ে ২০২২ সালের একটি মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। একইভাবে ছাত্রলীগের সভাপতি নুরউদ্দিন অপুর নেতৃত্বে গত ২৭ জুলাই হাতিরঝিল পশ্চিম থানার অফিস সম্পাদক শামীম হোসাইনকে দৈনিক সংগ্রামের সামনে অবস্থিত চাষি কল্যাণ ভবনের সামনে থেকে এবং ৩ আগস্ট হাতিরঝিল থানা জামায়াতের সেক্রেটারি রাশেদুল ইসলামকে গ্রিনওয়ে রাস্তার মুখ থেকে তুলে নিয়ে পুলিশকে দিয়ে মামলায় জড়ানো হয়। যা রাজনৈতিক শিষ্টাচার ও রীতি বিরুদ্ধ কাজ ও আইনের লঙ্ঘন।
সর্বশেষ গ্রেফতার ব্যক্তিদের মধ্যে ইউসুফ আলী মোল্লা ও মাকসুদুর রহমান সব মামলায় জামিন পেলেও কারা অভ্যন্তর থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয় বলে দাবি করেছে দলটি। আইনজীবীরা আদালতে প্রেস ব্রিফিংয়ে দাবি করেছেন তাদের অন্যায়ভাবে আটক করা হয়েছে যার মাধ্যমে হাইকোর্টের নির্দেশনাও লঙ্ঘন করা হয়েছে।

এমনি অবস্থায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক, মানবাধিকার ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বহির্বিশ্ব চরম উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে অনেক আগে থেকেই। তারা সুস্পষ্টভাবে বলেছে, দেশে সব নাগরিকের রাজনীতি ও মত প্রকাশ করার অধিকার আছে তা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। সভা-সমাবেশ ও রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে সহিংসতা আশা করে না যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির স্টেট ডিপার্টমেন্ট নিয়মিত ব্রিফিংয়ে এসব বিষয়ে বারবার তুলে ধরেছে।

মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার-বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারির কাছে সরাসরি রিপোর্ট প্রদানকারী জনসংখ্যা, শরণার্থী এবং অভিবাসন-বিষয়ক ব্যুরোর প্রধান (অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অব স্টেট) জুলিয়েটা ভ্যালস নয়েস বাংলাদেশ সফরে এসে বন্ধু এবং উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফে এটি স্পষ্ট করেছে যে, জাতীয় নির্বাচন যে ফর্মেই হোক তাতে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুযোগ করে দিতে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি প্রণয়ন করেছে। এতে স্পষ্ট করা হয়েছে যে, যারা সহিংসতা ও অরাজকতায় লিপ্ত হবে তারা মার্কিন ভিসানীতির আওতায় পড়বে। কিন্তু সরকার নির্বাচনকে ঘিরে সেই সহিংসতা ও প্রতিবন্ধকতাই তৈরি করে আসছে।

মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রধান ডেপুটি মুখপাত্র ভেদান্ত প্যাটেল এক নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বে গণতন্ত্রের ব্যাপ্তি এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাংলাদেশের সরকার, রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমসহ সবাই আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হওয়ার আকাক্সক্ষা প্রকাশ করেছে। এর আওতায় বর্তমান ও সাবেক বাংলাদেশী কর্মকর্তাসহ, সরকার কিংবা বিরোধী দল অথবা গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে দুর্বল করার জন্য যারা দায়ী বা জড়িত বলে মনে করা হবে তাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে।

এর আগে ২০২২ সালের ৮ নভেম্বর স্টেট ডিপার্টমেন্টের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলরত বিরোধীদল বিএনপিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হুমকি প্রসঙ্গে কথা বলেন মুখপাত্র নেড প্রাইস। তিনি বলেন, জনগণকে নিজেদের পছন্দের সররকারকে বেছে নেয়ার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। আগামী নির্বাচন হতে হবে অবাধ ও নিরপেক্ষ। নিশ্চিত করতে হবে সুশীল সমাজের ব্যাপকভিত্তিক অংশগ্রহণ।

দেশের সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যে খারাপ অবস্থায় নিয়ে গেছে বর্তমান সরকার এর দায়ভার এড়ানোর সুযোগ থাকবে না বলেই মনে হচ্ছে। বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াতসহ আলেম-ওলামাদের ওপর অত্যধিক পরিমাণে নিপীড়ন চালানো হয়েছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। যেখানে দেখা গেছে, পুলিশ প্রশাসন, দলীয় ক্যাডার বাহিনী, অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্নভাবে জড়িয়ে পড়েছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে আগামী নির্বাচন ঘিরে দেশ গভীর সঙ্কটের দিকে যাবে। সরকারের সব কর্মকাণ্ড এমনভাবে পরিচালিত হচ্ছে যা মানবাধিকার, আইনের শাসন, সংবিধান, গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক সহাবস্থানের বিবেচনায় বলা যায় যে দেশ রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। যা কোনো মতেই গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের প্রতিফলন ঘটায় না।

লেখক : কলামিস্ট

Print Friendly, PDF & Email
 
 
জনতার আওয়াজ/আ আ
 

জনপ্রিয় সংবাদ

 

সর্বোচ্চ পঠিত সংবাদ