ডেঙ্গুতে মৃত্যু মশার মতো ‘উন্নয়নের গান’ শোনাচ্ছে সরকার
নিজস্ব প্রতিবেদক, জনতার আওয়াজ ডটকম
প্রকাশের তারিখ:
বৃহস্পতিবার, আগস্ট ২৪, ২০২৩ ৩:৫৫ অপরাহ্ণ পরিবর্তনের তারিখ:
বৃহস্পতিবার, আগস্ট ২৪, ২০২৩ ৩:৫৫ অপরাহ্ণ

ড. মোর্শেদ হাসান খান
আগস্ট ১৮, ২০২৩, ডেঙ্গুতে রাজধানীর একটি হাসপাতালে মারা গেছে শিশু ওমর বিন সাইফ। ১১ পারা কোরাআনের হাফেজ শিশু সাইফের মৃত্যু কাহিনী বড় হৃদয়বিদারক। বেসরকারি একটি হাসপাতালে ভর্তি করিয়েও আন্তরিক সেবা জুটেনি তার কপালে। উপরন্তু অবস্থা খারাপ হলে সিনিয়র ডাক্তার ডাকার অপরাধে শিশুটির বাবা-মার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে সেখানকার স্টাফরা। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার আগমুহুর্তে একটু পানির আকুতি জানিয়েছিলো সাইফ কিন্তু তাও দেয়া হয়নি। এই বাবা-মাকে এখন সান্ত্বনা দেবে কে? ঠিক কী করলে ক্ষতি পোষাতে পারবেন তারা? এর কোনো উত্তর নেই।
২০২৩ সালে আগস্ট ২৩, পর্যন্ত শিশু সাইফের মতো ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ৫০৬ জনের মৃত্যুর দৃশ্যও নিশ্চয়ই এমন হৃদয়স্পর্শী। কোনো কোনোটি এর চেয়ে ভয়ানক ও কষ্টেরও হতে পারে। প্রতিদিন ১০ জনের ওপরে যে মৃতুর ঘটনা ঘটছে তার কয়টি ঘটনাই বা আমরা জানছি। ক’জন বাবা-মা কিংবা সন্তানের আহাজারি আমাদের কানে আসছে? চলতি বছর আজ পর্যন্ত লক্ষাধিক মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হসপিটালে ভর্তি হয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা আরও বেশি হবে। কারণ অনেক ডেঙ্গু রোগী বাসায় থেকে চিকিৎসা নেন, তাদের হিসাব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের খাতায় নেই। আবার দেশের সকল হসপিটালের ডাটাও নেই।
রোগটি নিয়ন্ত্রণে বিশেষজ্ঞরা আগেই কার্যকর নানা পরামর্শ দিয়েছেন। এমনকি মশার এই আগ্রাসন যে নিয়ন্ত্রণযোগ্য, সে কথাও সরকারের অজানা ছিল না। সমস্যা হলো মশা মারার কাজ যাদের, তাদের আত্মতুষ্টি আর ওপর মহলের আশকারা। কারণ, কাফনে মোড়া শিশু, মা-বাবার আহাজারি, যন্ত্রণায় কাতর রোগী কিংবা স্বজনদের ভোগান্তির কোনো কিছুই তাদের আর স্পর্শ করছে না। তারা আত্মতুষ্টির ঢেকুর তুলে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছেন।
জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক ওয়ার্ল্ড মসকুইটো প্রোগ্রামও ‘ওলবাচিয়া’ নামে একটি পদ্ধতি নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কথা বলেছিল। পদ্ধতিটি যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল -সিডিসি অনুমোদিত। ওলবাচিয়া একধরনের ব্যাকটেরিয়া, মশার ডিমে এই ব্যাকটেরিয়া প্রয়োগ করলে একসময় ওলবাচিয়া মশা এডিস মশাকে প্রতিস্থাপন করে ফেলে।
ওয়ার্ল্ড মসকুইটো প্রোগ্রামের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পিটার রায়ান জানান, ২০১৮ সালে তিনি স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। তারপর এ দুই জায়গায় বিভিন্ন পদে লোকের পরিবর্তন হয় ও এসে যায় করোনাভাইরাস প্যান্ডেমিক। কথাবার্তা আর এগোয়নি। ২০২২ সালে আবারও তারা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কথা বলেন। সেখানেও তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।
বিশ্বের বহু দেশ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে সফলভাবে ডেঙ্গু মোকাবিলা করেছে। কর্তৃপক্ষের তো মানুষের জান বাঁচানো আর ভোগান্তি কমানোর দিকে নজর নেই। গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান দেখলেই যে কেউ তা বুঝতে পারবে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট- আইইডিসিআর-এর হিসাবে ২০১২ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ৬৭১ জন, ২০২২ সালে এই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৪১ হাজার ৪৮১। ইনস্টিটিউটের ওয়েবসাইটে মৃত্যুর পরিসংখ্যান আছে ২০১৫ সাল থেকে। ওই বছর মারা যান ছয়জন। আর ২০২২ সালে মারা যান ২৮১ জন। এ বছর গত ২৩ জুলাই পর্যন্ত মারা গেছেন ১৮৫ জন। অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুর ঝাপটা অব্যাহত থাকবে-জনস্বাস্থ্যবিদেরা আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করে রেখেছেন। আরও কত মানুষ যে স্বজনহারা হবেন, তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই।
দেশে এখন কোনো সমস্যাই আর সমস্যা না। উন্নয়নের গল্প বলা এই সরকারের প্রতিটি সেক্টর থেকে এমন ভাবে গল্প বানানো হয় যেন পৃথিবীর সব থেকে নিরাপদ, সবথেকে উন্নত এবং আন্তরিক সেবার মাধ্যমে মুহূর্তেই সারিয়ে তোলা হয়েছে সব রোগ। যেমন, গত বছর ডেঙ্গুতে এত প্রাণহানির পরও স্থানীয় সরকার বিভাগ তাদের আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার কার্যবিবরণীতে লিখেছে, ‘২০১৯ সালে যখন ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পেয়েছিল, তখন মাননীয় মন্ত্রী সবাইকে সঙ্গে নিয়ে নিয়মিত সভা করে ও মাঠ পরিদর্শন করে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সফলতা অর্জন করেন।’ পরের বছরগুলোতেও নাকি মন্ত্রীর এই সফলতা অব্যাহত ছিল। প্রশ্ন হলো তিনি এবং তার মন্ত্রণালয় যদি সফলতার সে ধারা অব্যাহত রাখেন তাহলে এবছর এতো মৃত্যু কেন?
পরিসংখ্যান বলছে, ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যুর হার এ বছরে ২০১৯ সালের তুলনায় প্রায় ৭ গুণ বেশি। তাদের প্রায় ৭০ শতাংশের বয়স ৩০ বছরের মধ্যে এবং ৮০ শতাংশের বয়স ৪০ বছরের মধ্যে। যাদের মধ্যে রয়েছেন সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী কিংবা খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। যারা প্রত্যেকেই ছিলেন একেকটি পরিবারের স্বপ্ন, আশা এবং ভরসা। তাদের মৃত্যুতে পরিবারগুলো নি:শ্বেস হয়ে গেছে।
সরকারের উপর থেকে শুরু করে নিচ পর্যন্ত প্রতিটি সেক্টর আজ ভয়ঙ্কর রকমের মিথ্যা ও আজগুবি রোগে আক্রান্ত। সেই আজগুবি এবং নির্লজ্জ মিথ্যাচার এখন আরো বেশি ডালপালা মেলে সগৌরবে বিস্তার লাভ করছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ফজলে নূর তাপস ৬ জুলাই বলেছেন, ‘ডেঙ্গু রোগ নির্মূল করা যায় না, বরং নিয়ন্ত্রণ করা যায়। পৃথিবীর কোনো দেশ করতে পারেনি। কিন্তু আমরা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছি।’ এ কথা বলে তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বিদেশে লম্বা অবকাশ যাপনে বেরিয়ে পড়েন। আর উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম নাকি বিটিআই আনার চেষ্টা করছেন। এর আগে অবশ্য তিনি মশা মারা শিখতে যুক্তরাষ্ট্র ঘুরে এসেছেন। যদিও বিটিআই নিয়ে আগেই এ দেশের বিজ্ঞানীরা কথা বলেছেন।
গণমাধ্যমের বিভিন্ন প্রতিবেদন বলছে, দুর্নীতি আর হরিলুটের দেড় দশকে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে স্বাস্থ্য খাত। জবাবদিহিহীন সরকারের এই খাতটির লুটপাট আর স্বেচ্ছাচারের নানা কর্মকাণ্ড করোনাভাইরাস মহামারির পরও থেমে নেই। বরং দিন দিন হঠকারী সিদ্ধান্ত বেড়েই চলেছে। যত্রতত্রভাবে মেডিকেল কলেজের সংখ্যা বৃদ্ধি এই খাতের খামখেয়ালিপনার বড় উদাহরণ। সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা দিন দিন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি না করে কিংবা উপযুক্তসংখ্যক শিক্ষকের সংস্থান না করে নতুন মেডিকেল কলেজে পাঠদান চালু করার যে প্রবণতা চলছে, তাকে একটি ‘রোগ’ বলা যেতে পারে। বাছবিচারহীনভাবে এসব মেডিকেলের অনুমোদন দেয়ার পেছনে সেবা নয় বরং দুর্নীতি ও লুটপাটই শাসক শ্রেণির আসল উদ্দেশ্য।
এই খাতের খামখেয়ালিপনার চূড়ান্ত রূপ হলো অযাচিতভাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে দুটি বিভাগে ভাগ করে উক্ত মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন দপ্তরকে অযৌক্তিক এবং অবৈজ্ঞানিকভাবে এ দুটি বিভাগের অধীনে বণ্টন করা। এর ফলে কার্যত বিগত ছয় বছরে দুই বিভাগের মধ্যে রেষারেষি চরমে পৌঁছেছে এবং সমন্বয়হীনতায় কাজের গতি অনেকটা ধীর হয়েছে।
পরিবার-পরিকল্পনা সেবা প্রতিরোধমূলক প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর কোনো দেশেই এ দুটি সেবা আলাদাভাবে দুটি ভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে প্রদান করা হয় না। বাংলাদেশে পরিবার-পরিকল্পনা অধিদপ্তর গঠনের মাধ্যমে ১৯৭৫ সাল থেকে স্বাস্থ্যসেবা এবং পরিবার-পরিকল্পনা সেবা মাঠ পর্যায়ে (অর্থাৎ জেলা থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে) দুটি ভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে।
উপযুক্ত প্রস্তুতি ছাড়া আগের দিন নোটিশ পাঠিয়ে কিছু সরকারি হাসপাতালে ইনস্টিটিউশনাল প্রাইভেট প্র্যাকটিস প্রচলন করা হচ্ছে বর্তমানে। যা স্বাস্থ্যখাতে স্বেচ্ছাচারিতার নতুন সংযোজন। ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস চালুর শর্তগুলো হলো সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে পর্যাপ্তসংখ্যক চিকিৎসক ও সহায়ক জনবলের উপস্থিতি নিশ্চিত করা এবং একই ক্লিনিক্যাল গ্রুপের একাধিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কর্মরত থাকা এবং প্রয়োজনীয় ডায়াগনস্টিক টেস্টের ব্যবস্থা থাকা।
কিন্তু এই শর্তগুলো পূরণ ছাড়া ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস চালুর ফলে এটির উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। তবে ফল যা-ই হোক, এ ব্যবস্থার কিছু উল্টো ফলের আশঙ্কা রয়েছে। যেমন এ ব্যবস্থা চালুর ফলে কর্মক্ষেত্রে নির্ধারিত কর্মঘণ্টায় চিকিৎসকদের উপস্থিতি কমতে পারে। তাই নির্ধারিত কর্মঘণ্টায় সেবা নিতে আসা রোগীরা মানসম্মত সেবা থেকে বঞ্চিত হবে। ইতোমধ্যে এর প্রভাব আমরা দেখেছি। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে রোগীদের মৃত্যুর ঘটনায় সময় মতো চিকিৎসক না পাওয়াকে দূষছেন অভিভাবকরা। আর এ অভিযোগ থেকে বাঁচতে চিকিৎসকদের ডিউটি আওয়ারের অযুহাত খাঁড়া করার প্রবণতা দেখা গেছে।
দেশের মূল ধারার গণমাধ্যমসহ সামাজিক মাধ্যমে ডেঙ্গু নিয়ে যেসব তথ্য-উপাত্ত কিংবা ঘটনা চোখে পড়ছে তাতে মানুষের ক্ষোভের প্রকাশ ঘটছে। এই ক্ষোভ দেশের স্বাস্থ্যখাত নিয়ে যতোটা না তার চেয়ে বেশি সরকারের দুর্নীতি, লুটপাট আর অবব্যস্থাপনা নিয়ে। জীবন-মৃত্যুর অত্যাবশ্যকীয় যায়গাটিকে পাশ কাটিয়ে কেবল উন্নয়নের ফাঁকা বুলি আওড়িয়ে সরকার জনগণকে ভুলিয়ে রাখতে চাইছে। অথচ সাধারণ জনগণ যে সবই জানে এবং বোঝে কেবল সেটিই বুঝতে চাইছে না এই গণবিরোধী ফ্যাসিস্ট সরকার।
জনতার আওয়াজ/আ আ
