পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিং : কূটনীতিকরা শুনেছেন, কোনো কথা বলেননি
নিজস্ব প্রতিবেদক, জনতার আওয়াজ ডটকম
প্রকাশের তারিখ:
মঙ্গলবার, অক্টোবর ৩১, ২০২৩ ১২:১৩ পূর্বাহ্ণ পরিবর্তনের তারিখ:
মঙ্গলবার, অক্টোবর ৩১, ২০২৩ ১২:১৩ পূর্বাহ্ণ
নিউজ ডেস্ক
দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশেষ করে গত ২৮শে অক্টোবর বিএনপি’র মহাসমাবেশ ঘিরে যেসব ঘটনা ঘটেছে তার সরকারি ভাষ্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের জরুরি নির্দেশনা পেয়ে সোমবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনা’য় এক কূটনৈতিক ব্রিফিংয়ে তা তুলে ধরা হয়। ঢাকাস্থ প্রায় অর্ধশত বিদেশি কূটনৈতিক মিশনের প্রধান (রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার বা চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স), জাতিসংঘের অধীন বিভিন্ন সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ পরিস্থিতি বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ ওই ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন। কূটনৈতিক সূত্র বলছে, ব্রিফিংয়ে মোটাদাগে ৩টি বিষয় খোলাসা করা হয়। এক. অতীতের ধারাবাহিকতায় ২৮শে অক্টোবর বিএনপি ‘ধংসাত্মক’ কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। একজন পুলিশকে স্পটে হত্যা করাসহ আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর ওপর উপর্যুপরি আক্রমণ হয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী ধৈর্য্যরে সঙ্গে তাৎক্ষণিক কিছু পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে, বাড়তি বল প্রয়োগ করেনি।
২. বিদ্যমান সংবিধান মেনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। তাতে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিতের চেষ্টা করা হবে। নির্বাচনটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণভাবে আয়োজনে নির্বাচন কমিশনকে সর্বাত্মক সহযোগিতায় অঙ্গীকারবদ্ধ সরকার। সরকারের এমন অবস্থান মেনে চাইলে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিতে পারে।
এর বাইরে কিছু চিন্তা করলে আইন নিজস্ব গতিতেই চলবে।
৩. বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের যখন-তখন বিবৃতি নয়, বরং কোনো বক্তব্য থাকলে ভিয়েনা কনভেনশনের আলোকে সরকারের সঙ্গে আগে কথা বলতে হবে। এর বাইরে গিয়ে কোনো দূতাবাস (আগবাড়িয়ে) কোনো ইস্যুতে বিবৃতি দিলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না।
সূত্রমতে, ২৮শে অক্টোবরের সব ঘটনার দায় একতরফাভাবে বিএনপি’র ঘাড়ে চাপানো, আসন্ন নির্বাচন প্রশ্নে সরকারের অনড় অবস্থান এবং সর্বশেষ বিদেশিদের বক্তব্য বিবৃতি-প্রদানে নিরুৎসাহিত করার বয়ান শুনে ব্রিফিংয়ের প্রায় পুরোটা সময় নীরব ছিলেন কূটনীতিকরা। কাছের কিংবা দূরের, পূর্বের বা পশ্চিমের কোনো বন্ধু রাষ্ট্র কিংবা উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধি একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। ব্রিফিং শেষে সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রী-উপদেষ্টার সম্মিলিত সংবাদ সম্মেলনে ‘কূটনীতিকদের নীরবতা’ নিয়ে অব্যাহত প্রশ্ন আসে। জবাবে প্রায় অভিন্ন ভাষায় তারা বলেন, সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করার পর আমন্ত্রিত কূটনীতিকদের জন্য প্রশ্ন আহ্বান করা হয়, তাদের মতামত দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়। কিন্তু কেউ প্রশ্ন করেননি বা কোনো মন্তব্য করেননি। তারা কেবলই শুনেছেন!
কূটনীতিকেরা সরকারের ব্রিফিংয়ে সন্তুষ্ট কী না জানতে চাইলে বিরক্ত হয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, তারা সন্তুষ্ট হয়েছেন, কি হননি সেটা তাদেরই জিজ্ঞেস করুন। এ বিষয়ে সম্পূরক আইনমন্ত্রী এডভোকেট আনিসুল হক বলেন, আমরা কিন্তু বলিনি যে, সাইলেন্স (নীরবতা) মানে সম্পূর্ণ এগ্রি (একমত পোষণ) করেছেন। আবার আমরা এটাও বলছি না যে তারা ডিজএগ্রি (ভিন্নমত পোষণ) করেছেন। আমরা বলছি উনাদের প্রশ্ন করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, উনারা কোন প্রশ্ন করেননি। তার মানে আমরা যতটুকু বুঝতে পারি, আমরা যে ব্যাখ্যা দিয়েছি সেটা অন্তত তাদের কাছে পরিস্কার হয়েছে। উনারা কনভিন্সড কি কনভিন্সড নন সেটা বলার দায়িত্ব আমাদের না। সেটা তারাই বলতে পারবেন।
কূটনীতিকদের প্রশ্ন না করার বিষয়টি উল্লেখ করে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, এখানে সব রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা ছিলেন। তারা সকলেই চুপ ছিলেন। এটা ধরে নেয়ার কারণ নেই যে, তারা আমাদের সঙ্গে ডিজএগ্রি করেছেন। কারণ তারা কেউ কোন কথা বলেননি। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম জানান, ২৮শে অক্টোবর যেসব ঘটনা ঘটেছে, তাৎক্ষণিক যেসব ফুটেজ পাওয়া গেছে, সেগুলো বিদেশি মিশনগুলোতে পাঠিয়েছি। আজকে আবার তাদের সহিংসতার ভিডিও ফুটেজ ছবিসহ নানা ডকুমেন্ট দেখানো হয়েছে। বিদেশি কূটনীতিকদের বক্তব্য কী ছিলো জানতে চাইলে শাহরিয়ার আলম বলেন, তাদের অভিব্যক্তি দেখে বোঝা গেছে, তারা এসব দেখে স্তব্ধ হয়ে গেছেন। ব্রিফিংয়ের সূচনা বক্তৃতায় আব্দুল মোমেন বলেন, ২৮ অক্টোবর যা ঘটেছে তাতে আমরা মর্মাহত। যদিও অতীতে বিএনপি-জামায়াতের সহিংসতার অভিজ্ঞতা থাকায়, আমরা অতোটা বিস্মিত হইনি। দুঃখের সঙ্গে বলছি, আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম তারা বদলাবে, কিন্তু তারা পাল্টায়নি।
ব্রিফিংয়ের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের আরও বলেন, শান্তিপূর্ণ শোভাযাত্রার নাম নিয়ে বিএনপি যেসব সংঘাত-সহিংসতা করেছে আমরা তার তীব্র নিন্দা জানাই এবং তাদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনা দরকার। গত কয়েকদিনে তারা যা করেছে, তার মূল উদ্দেশ্য নির্বাচন যেন অবাধ ও সুষ্ঠু না হয়। নির্বাচনকে বানচাল করার জন্য তারা এ ধরনের অপকর্ম করেছে। আমরা সেজন্য বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের ডেকেছি। তাদের বলেছি, ২৮ তারিখে এখানে কী হয়েছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের মিথ্যা উপদেষ্টা হিসেবে একজনকে নিয়ে কী কী করা হয়েছে, সেটাও তুলে ধরেছি।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, যমুনার ওই ব্রিফিংয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিদেশি কূটনৈতিক মিশন, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের কাছে ২০ পৃষ্ঠার একটি সরকারী ভাষ্য দেওয়া হয়েছে। ‘ছবিতে বিএনপির নৃশংসতা’ শিরোনামের ওই উপস্থাপনায় গত ২৮ ও ২৯ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ এবং হরতালে যে সব সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে তাও তুলে ধরা হয়েছে। ব্রিফিংয়ে উপস্থিত একাধিক কূটনীতিকের কাছে আলোচনার বিষয়ে জানতে চাইলে তারা কোন মন্তব্য করতে চাননি। তবে প্রশ্ন না করার বিষয়টি উল্লেখ করে তাঁরা জানিয়েছেন, সরকার ২৮ শে অক্টোবর এবং পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে কি বলতে চাইছে তারা তা শুধু শুনতে এসেছিলেন। প্রশ্ন করার অভিপ্রায় তাদের ছিল না। ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম যোগ দিয়েছিলেন। পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান সরকারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা এতে অংশ নেন। তবে অতীতের ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের টেরিটরিয়াল ডেস্কের ডিজি এবং সেগুনবাগিচার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দেখা গেলেও এবার তাদের অনেকেই ছিলেন অনুপস্থিত।
ব্রিফিংয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের মধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস, চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন, জাপানের রাষ্ট্রদূত ইওয়ামা কিমিনোরি ছাড়াও বৃটেন, রাশিয়া, চীন, জার্মানি, ফ্রান্স, কানাডা, ইতালি, জাপান, ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক, স্পেন, সিঙ্গাপুর, রাশিয়া, জাপান, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, ইইউর কূটনীতিক এবং জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার ৬ জন প্রতিনিধি অংশ নেন। উল্লেখ্য, ২৮ শে অক্টোবর বিশ্বের নানা প্রান্তে থাকা বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতে পাঠানো এক নোটে বলা হয়েছিল, বিএনপি প্রতিটি নির্বাচনের আগে অসদুদ্দেশ্যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বিঘ্নিত এবং অগণতান্ত্রিক শক্তিকে উৎসাহিত করতে সহিংসতা চালায়। ২৮ অক্টোবরের সহিংসতা এরই ধারাবাহিকতা মাত্র।
আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী আরও যা বললেন: এদিকে ব্রিফিং শেষে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনের সূচনাতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিএনপিকে নির্বাচনে আসার অনুরোধ জানান। বলেন, আমরা তাদের (বিএনপি) অনুরোধ করবো, আপনারা নির্বাচনে আসেন। নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হয়। আমরা আমাদের শাসনতন্ত্র অনুযায়ী নির্বাচন করবো। সহিংসতা করে সরকার পতনের যে চেষ্টা, এটা অলীক। এরপর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, প্রধানমন্ত্রী অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিষয়ে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সে ব্যাপারে আমরা কূটনীতিকদের পুনর্ব্যক্ত করেছি। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। নির্বাচন প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হলে বর্তমানে যে প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে, সেটা মেনেই অংশগ্রহণ করতে হবে। মার্কিন প্রেসিডেন্টের তথাকথিত উপদেষ্টার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে শাহরিয়ার আলম বলেন, কথিত মার্কিন উপদেষ্টার জন্য কনস্যুলার অ্যাক্সেস চেয়েছে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস। আইন অনুযায়ী আমরা বিষয়টি দেখবো। সূত্রঃমানবজমিন