প্রায় শতভাগ বিএনপি নেতাকর্মী ভারতীয় পণ্য বর্জন সমর্থন করে
নিজস্ব প্রতিবেদক, জনতার আওয়াজ ডটকম
প্রকাশের তারিখ:
শুক্রবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৪ ১২:৩৭ পূর্বাহ্ণ পরিবর্তনের তারিখ:
শুক্রবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৪ ১২:৩৭ পূর্বাহ্ণ
জনতার আওয়াজ ডেস্ক
বুধবার সকাল ১০টার একটু এদিক-সেদিক। নয়াপল্টনে বিএনপি’র কেন্দ্রীয় কার্যালয়। অনেকটা ‘ক্লান্ত’। নেতাকর্মীদের ভিড় নেই। মূল ফটকের পাশে চা খাচ্ছেন দুই-চার জন। সময় নেয়া ছিল আগেই। সিঁড়ি বেয়ে তিন তলায় পৌঁছাতেই পাওয়া গেল তাকে। এডভোকেট রুহুল কবির রিজভী। বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব। দপ্তরও সামলাচ্ছেন দীর্ঘদিন ধরে।
কখনো প্রশংসিত। কখনো কেউ কেউ প্রশ্নও তুলেছেন তাকে নিয়ে। কিছুক্ষণ পরেই সংবাদ সম্মেলন। তার স্ক্রিপট তৈরির কাজ চলছে। অল্প কিছু নেতাকর্মীর উপস্থিতি। মানবজমিনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে রুহুল কবির রিজভী ভারতীয় পণ্য বর্জন আন্দোলনে নিজের সমর্থনের কথা জানালেন ফের। দাবি করলেন, বিএনপি’র প্রায় শতভাগ নেতাকর্মী এ আন্দোলন সমর্থন করে। যদিও দল সেভাবে এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। বিভিন্ন প্রশ্নের খোলামেলা জবাব দিলেন। কিছু বিষয় খোলাসা হওয়া গেল, কিছু গেল না। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাজেদুল হক। সঙ্গে ছিলেন কিরণ শেখ ও হুমায়ূন কবির মাসুদ
বিএনপি কেন পারেনি?: গেল চারটি নির্বাচন হয়েছে চার মডেলের। দু’টিতে বিএনপি অংশ নিয়েছে, দু’টিতে নেয়নি। তবে আখেরে যেটা দাঁড়িয়েছে প্রতিটি নির্বাচনেই বিএনপি এবং তার জোট অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। কেন পারেনি বিএনপি? প্রশ্ন রেখেছিলাম রুহুল কবির রিজভীর কাছে। শুরুতে যথারীতি তিনি অন্য বিএনপি নেতাদের মতোই উত্তর দিয়েছেন। ক্ষাণিক পরেই অবশ্য ভিন্নতার দেখা মেলে। রিজভী বলেন, বিএনপি যে রাজনৈতিক নীতি-আদর্শ নিয়ে আন্দোলন করেছে আমি মনে করি সে আন্দোলন সর্বাত্মকভাবে সফল হয়েছে। কারণ বিএনপি জনগণকে বলেছে ভোট বর্জন করতে। জনগণ এতে সাড়া দিয়েছে। ৯৫-৯৭ পার্সেন্ট ভোট যে পড়েনি সেটা তো দৃশ্যমান। গণমাধ্যম থেকেই আমাদের দেখা। আমরা নিজেরাও পর্যালোচনা, বিশ্লেষণ করে দেখেছি। এ ধরনের নির্বাচনকে সাফল্য বলে চালিয়ে নেয়া, এটা ওবায়দুল কাদেররা বলতে পারেন। কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষ, বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়, শ্রমজীবী মানুষ কেউ বলেনি যে, এটা প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন। এ নির্বাচনে জনগণের ইচ্ছার কোনো প্রতিফলন হয়নি। আন্তর্জাতিক মিডিয়া, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক তারাও একই কথা বলেছেন।
‘আমি ঠিক ২০২৪ এ নেই, আমি যেটা বলতে চেয়েছি বিএনপি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চেয়েছে কিন্তু বিএনপি তো সেটা আদায় করতে পারেনি। এটা নিয়ে কি বিএনপি’র ভেতরে কোনো পর্যালোচনা আছে?’ রিজভী বলেন, পর্যালোচনা তো আমরা প্রতিদিনই করছি। পর্যালোচনা তো করেই যাচ্ছি। পারেনি জিনিসটা এক। আর কেন পারেনি বা পরিস্থিতি কী সেটা ভিন্ন। স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন করে সফল হওয়া যায়, এর জন্য হয়তো সময় লাগে। কিন্তু ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন দিয়ে সম্ভব হয় না। সেখানে যুদ্ধ বা বিদেশি সহায়তা প্রয়োজন হয়। সাদ্দাম হোসেন, গাদ্দাফীর পতন তো কোনো আন্দোলনে হয়নি। বিএনপি তো কোনো সশস্র সংগঠন নয়। বিএনপি একটি নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। আমরা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সংগ্রাম করছি। গত আন্দোলনেও ২২ জন আমাদের নিহত হয়েছেন। একটি রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে তো খালি হাতে লড়াই করা যায় না। তবে অগণতান্ত্রিক এবং জনবিরোধী শক্তির পতন অবশ্যম্ভাবী। হয়তোবা পতন প্রলম্বিত হতে পারে।
দিল্লির চাপে ওয়াশিংটন পিছু হটেছে?: ঢাকায় নিযুক্ত সাবেক ভারতীয় হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীর একটি বক্তব্য সম্প্রতি বিপুল আলোচনা তৈরি করে। বাংলাদেশে গত ৭ই জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস্কে কার্যত গাঢাকা দিতে হয়েছিল’ এমন মন্তব্য করেন তিনি। যদিও ওয়াশিংটন বিষয়টি পরে নাকচ করে দেয়। এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে রিজভী বলেন, বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক দল যারা দখলদার শাসক হিসেবে আজকে সারা দেশের মানুষের কাছে পরিচিত তাদের পক্ষে উনি। উনার কথা শুনে মনে হয়েছে এই ফ্যাসিবাদের রক্ষক উনারা। আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্ট তারা যে বক্তব্য দিয়েছে তারা তো বলেনি ভারতের চাপে সরে গেছে। তারা তো কোনো দলের পক্ষে ছিল না। তারা কী চেয়েছে? তারা তো চেয়েছে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। সেটা শুধু আমেরিকা চায়নি। অনেক দেশই চেয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা বাংলাদেশের জনগণ চেয়েছে। আমেরিকা সুস্পষ্টভাবে বলেছে, তারা কোনো দলের পক্ষে না। তারা অবাধ নির্বাচনের পক্ষে। পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীর যে বক্তব্য উনার কথা হলো আমেরিকার উচিত ছিল শেখ হাসিনার পাশে থাকা। তিনি যে বক্তব্য রেখেছেন তার নির্যাসটা হচ্ছে তারা যেহেতু শেখ হাসিনার পক্ষে সেই পক্ষে আমেরিকার থাকা উচিত ছিল। তাদের চাপে তারা পরে চুপ করে গেছে। এটা তার বক্তব্য। এ বক্তব্যের মাধ্যমে প্রমাণ হয় ভারত তার সমস্ত শক্তি নিয়ে শেখ হাসিনার পক্ষে দাঁড়িয়েছে। এবং একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন, একতরফা, জালিয়াতি ও ডামি নির্বাচন সম্পন্ন করতে একমাত্র ভারত তাদের সহযোগিতা করেছে। যেটা আজ পিনাক রঞ্জন, বীণা সিক্রি তাদের বক্তব্যে উঠে এসেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি কারও চাপের ওপর নির্ভর করে? তারা পৃথিবীর বৃহৎ পরাশক্তি। তারা তাদের মতাদর্শ অনুযায়ী কৌশল নির্ধারণ করে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ভারতের সঙ্গে বিএনপি’র কোনো সমঝোতা ছিল কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জাতীয়তাবাদী দল কাউকে প্রভু মানে না। ২০১৮ সালে এটা প্রমাণ হয়েছে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে জনগণ ভোটকেন্দ্রে যেতে পারে না। অনেক আন্তর্জাতিক শক্তি বলেছিল নির্বাচনে যেতে। নির্বাচনে গেলে কী হয় তা পরে দেখা গেছে।
ভারতীয় পণ্য বর্জন আন্দোলন: ভারতীয় পণ্য বর্জন আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে নিজের দেয়া বক্তব্য নিয়েও কথা বলেন রুহুল কবির রিজভী। যদিও তার ওই বক্তব্য নিয়ে বিএনপি নেতাদের মধ্যে নানা প্রতিক্রিয়া রয়েছে। তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম দৃশ্যত বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য আপনার বক্তব্যের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। এটা নিয়ে কি বিএনপিতে কোনো বিভক্তি রয়েছে? জবাবে তিনি বলেন, এটা তো আর সেভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে করা না। ন্যাশনালিস্ট পার্টির একজন কর্মী হিসেবে আমার কাছে মনে হয়েছে এ সামাজিক আন্দোলনটা যারা করছেন তারা সঠিক কাজ করছেন। আমি আমার মতামত প্রকাশ করেছি। আমি মনে করি আমার দলের প্রায় শতভাগ নেতাকর্মী এটার সঙ্গে একমত। যারা আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করেছে, যারা আমাদের স্বাধীন সত্তাকে অস্বীকার করে, যারা আমাদের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধকে বলে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, যারা চায় আমরা তাদের ওপর নির্ভরশীল হই- তাদের নিয়েই তো এই বক্তব্য। তাদের এক কর্মকর্তা ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর বলেছিলেন বাংলাদেশ অনেকবার তাদের রাডার থেকে ছুটে গেছে এবার আর ছুটতে দিবে না। এবং এটার আমরা অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলন দেখছি। এ বক্তব্যের কারণে বিএনপিতে কোনো চাপে নেই বলে জানান রিজভী। তিনি বলেন, যারা জনগণের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে না একটি জবরদখলকারী সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে তাদের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে যেকোনো জাতীয়তাবাদী মানুষই তাদের বিরুদ্ধে থাকবে। এমনকি আওয়ামী লীগ সমর্থিত কেউ কেউও আমাকে বলেছেন আপনি সঠিক কাজ করেছেন।
বিএনপি’র নেতৃত্ব, ভবিষ্যৎ: বিএনপি’র স্থায়ী কমিটিতে শূন্য পদ থাকা, নেতাদের বয়স ও শারীরিক সুস্থতা, রিজভীর নিজের বিএনপি’র দপ্তরে দীর্ঘ বছর ধরে দায়িত্ব পালন নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এ বিষয়টি উত্থাপন করলে তিনি বলেন, রাজনৈতিক দল তো একটি ডায়নামিক দল। নিয়ম, পদ্ধতি অনুযায়ী হবে। কিন্তু ১৬-১৭ বছর ধরে তো আমরা একটা যুদ্ধের মধ্যে আছি। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় তো আমরা দল পরিচালনা করতে পারছি না। একটা থানার কাউন্সিল হলে সেখানেও ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। কোনো নেতা সেখানে গেলে তাকে বাধা দেয়া হয়। অনেক সময় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আর স্থায়ী কমিটি তো নীতি নির্ধারণী কমিটি। সেখানে তো বয়স্ক, অভিজ্ঞরাই থাকবে। রিজভী বলেন, আমি মনে করি বিএনপি’র ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। কারণ জনগণের স্বপক্ষে সে তার রাজনৈতিক সংগ্রাম করছে। নিপীড়ন, নির্যাতন, গুম, রাষ্ট্রের শত অত্যাচার সত্ত্বেও বিএনপি আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তাতে আমি বলতে পারি বিএনপি টিকে থাকবে, ওরাই বিলীন হয়ে যাবে। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, ধর্মীয় মূল্যবোধের নীতিতে বিএনপি অবিচল আছে বলে দাবি করেন রিজভী। বলেন, এ জন্যই তো আমরা ভারতীয় পণ্য বর্জনের কথা বলি। সূত্রঃ মানবজমিন