ফ্যাসিবাদের মেকানিক্স: শেখ হাসিনার সরকারের উত্থান ও পতন
নিজস্ব প্রতিবেদক, জনতার আওয়াজ ডটকম
প্রকাশের তারিখ:
বুধবার, সেপ্টেম্বর ১১, ২০২৪ ৩:৫২ অপরাহ্ণ পরিবর্তনের তারিখ:
বুধবার, সেপ্টেম্বর ১১, ২০২৪ ৩:৫২ অপরাহ্ণ
ড. সিরাজুল আই. ভূঁইয়া
ফ্যাসিবাদ এমন একটি শব্দ যা নিপীড়ন এবং ভীতির সঞ্চার করে। প্রায়শই কর্তৃত্ববাদী ক্ষমতা, ভিন্নমতের ওপর নির্মম দমন, চরম জাতীয়তাবাদ এবং একক নেতার হাতে কুক্ষিগত ক্ষমতাকে বোঝাতে এই শব্দ ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশের জনগণ যারা শেখ হাসিনার অধীনে বছরের পর বছর কর্তৃত্ববাদ সহ্য করেছে, তারা এই বৈশিষ্ট্যগুলোর সঙ্গে পরিচিত। হাসিনার শাসনের পতন ইতিহাস জুড়ে অনেক ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনকে প্রতিফলিত করে। যাদের উত্থান হয় ভয় ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে। কিন্তু অবশেষে জনগণের প্রতিরোধ ও দুঃশাসনের ভারে অনিবার্যভাবে সেই শাসন ভেঙে পড়ে। হাসিনা যে দমনমূলক নীতি প্রয়োগ করেছিলেন এবং যে শক্তি তার পতনের কারণ ছিল তা বিশ্লেষণ করে আমরা ফ্যাসিবাদের প্রকৃতি এবং এর ব্যর্থতাকে আরও ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারি।
ফ্যাসিবাদ ও এর মূল বৈশিষ্ট্য
ফ্যাসিবাদ বেশকিছু মৌলিক নীতির উপর নির্ভর করে-
১. সর্বগ্রাসী নেতৃত্ব: ফ্যাসিবাদী শাসন ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করে একক নেতার চারপাশে, যিনি সমস্ত বিষয়ে চূড়ান্ত কর্তৃত্বের অধিকারী হিসেবে অবস্থান করেন। রাজনৈতিক ভিন্নমতের কোনো অবকাশ সেখানে থাকে না এবং সেই নেতাকে নির্দোষ হিসাবে চিত্রিত করা হয়।
২. বিরোধীদের দমন: ফ্যাসিবাদের একটি মূল নীতি হল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করা। ভীতি প্রদর্শন, কারাবাস বা এমনকি সহিংসতার মাধ্যমেই হোক না কেন, ফ্যাসিবাদী শাসনগুলো তাদের নিয়ন্ত্রণের সম্ভাব্য হুমকিকে দমন করে।
৩. তথ্য ও প্রচারের ওপর নিয়ন্ত্রণ: ফ্যাসিস্ট নেতারা প্রচারের ওপর খুব বেশি নির্ভর করে। এর মাধ্যমে তারা তাদের শাসনকে মহিমান্বিত করে এবং যে কোনো বিরোধিতাকে নির্মূল করে।
বিজ্ঞাপন
মিডিয়া আউটলেটগুলো কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় এবং বাকস্বাধীনতাকে মারাত্মকভাবে খর্ব করা হয়।
৪. জাতীয়তাবাদ ও জেনোফোবিয়া: ফ্যাসিবাদ প্রায়শই চরম জাতীয়তাবাদকে উৎসাহিত করে, যেখানে রাষ্ট্রকে ‘উচ্চতর’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয় এবং যে কোনও বাহ্যিক বা অভ্যন্তরীণ ভিন্নমতকে ‘দেশদ্রোহী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। প্রায়শই সংখ্যালঘু বা প্রান্তিক গোষ্ঠী জেনোফোবিয়া এবং বর্ণবাদের শিকার হয়।
৫. অর্থনৈতিক ও সামরিক নিয়ন্ত্রণ: ফ্যাসিবাদী সরকারগুলো প্রায়ই অর্থনীতির উপর সরাসরি নিয়ন্ত্রণ জোরদার করে। শাসক শ্রেণি নিজেদের সমৃদ্ধ করার জন্য শ্রমিক শ্রেণিকে উপেক্ষা করে বা নিপীড়ন করে। সামরিক শক্তির নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়ে সরকার আন্তর্জাতিক স্তরে নিজের আক্রমণাত্মক অবস্থান তুলে ধরে বা দেশের অভ্যন্তরে পুলিশিং চালায় ।
এখন শেখ হাসিনা সরকারের ক্ষেত্রে এই বৈশিষ্ট্যগুলো প্রয়োগ করলে দেখা যাবে সেখানে কোনো অমিল নেই। বিশেষ করে ক্ষমতার একত্রীকরণ, ভিন্নমত দমন এবং মিডিয়া ও বিরোধীদের ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে।
শেখ হাসিনার সরকার: ফ্যাসিবাদী
শেখ হাসিনা তার ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের অনেকগুলো বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করেছিলেন। ক্ষমতার ওপর তার দখল সুসংহত করা থেকে শুরু করে বিরোধী দলগুলো কোনঠাসা করা-তার নেতৃত্ব গণতন্ত্রের ছদ্মবেশে কর্তৃত্ববাদে পরিণত হয়েছিল। এখানে কিছু মূল কারণ রয়েছে যা প্রকাশ করে যে কীভাবে তার সরকার ফ্যাসিবাদী শাসনের অনুরূপ কাজ করেছিল:
১. ক্ষমতা একত্রীকরণ ও এক-দলীয় রাষ্ট্র
হাসিনার সরকার ক্রমবর্ধমানভাবে রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে কেন্দ্রীভূত করেছে, যা ফ্যাসিবাদের সর্বগ্রাসী দিককে প্রতিফলিত করে । তার শাসনামলে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে কারচুপির অভিযোগ উঠেছিলো এবং বিরোধী দলগুলো, বিশেষ করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রায়ই প্রান্তিক হয়ে পড়েছিল বা নির্বাচনে সরাসরি অংশগ্রহণে অসম্মত ছিল। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের কুখ্যাত নির্বাচনে ভোট কারচুপি এবং কম ভোটার উপস্থিতির ব্যাপক অভিযোগ সামনে এসেছে। বিশেষ করে বিরোধী সমর্থকদের কাছ থেকে, যা তার সরকারের প্রতি জনগণের অনাস্থাকে প্রতিফলিত করে।
২. বিরোধী ও ভিন্নমত দমন
হাসিনার শাসনব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন। তার সরকার ভিন্নমতের বিরুদ্ধে দমন, বিরোধী দলের প্রধান নেতাদের গ্রেপ্তার এবং সাংবাদিকদের মুখ বন্ধ করার জন্য বিশেষ পরিচিত ছিল। ২০১৮ সালে পাস হওয়া বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, সরকারকে রাষ্ট্র বা এর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ‘মানহানিকর’ বক্তব্য পেশ করার জন্য কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করার অনুমতি দেয়, যা কার্যকরভাবে বাকস্বাধীনতা রোধ করার সমতুল্য। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো বারবার বিরোধী দলের কর্মীদের গণবন্দি এবং বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিতর্কের জায়গা সঙ্কুচিত করার বিষয়ে সরকারকে সতর্ক করেছে ।
৩. মিডিয়া ও তথ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ
শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তথ্য প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত প্রচেষ্টা চালিয়েছে, যা ফ্যাসিবাদের আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। সরকার ব্যাপকভাবে মিডিয়ার ওপর নজরদারি ও সেন্সর করেছে। সমালোচনামূলক কণ্ঠস্বরকে দমিয়ে রাখা হয়েছে। স্বাধীন সাংবাদিকরা হয়রানি, গ্রেফতার বা আরও খারাপ আচরণের সম্মুখীন হয়েছেন। গণমাধ্যমের জন্য ক্রমবর্ধমান সীমাবদ্ধ পরিবেশ প্রতিফলিত করে হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী সংবাদপত্রের ফ্রিডম র্যাঙ্কিংয়ে নিচের দিকে নেমে গেছে।
৪. জাতীয়তাবাদ ও ‘মুক্তিযুদ্ধের’ উত্তরাধিকার
জাতীয়তাবাদ ছিল শেখ হাসিনার রাজনৈতিক বৈধতার অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। তিনি প্রায়শই তার পিতা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা তথা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করতেন। তার নেতৃত্বে এই ঐতিহাসিক আখ্যানটি শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষমতাকে সুসংহত করার জন্যই নয় বরং জাতীয়তাবাদী উন্মাদনা জাগিয়ে তোলার জন্য এবং তার সরকারকে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রকৃত রক্ষক হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল।
শেখ হাসিনার সরকার কেন ব্যর্থ হয়
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় নিজের দখল বজায় রাখা সত্ত্বেও শেখ হাসিনার সরকার শেষ পর্যন্ত নিজস্ব কর্তৃত্ববাদী শাসনের ভারে ভেঙে পড়ে। বেশ কয়েকটি কারণ এই সরকারের পতনে অবদান রেখেছে:
১ . দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক বৈষম্য
হাসিনার শাসনামলে সরকারি প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি বাসা বাঁধে। যদিও এই সময়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দেখেছিল, তবুও বেশিরভাগ সম্পদ কিছু রাজনৈতিক অভিজাত এবং ক্ষমতাসীন দলের অনুগতদের হাতে কেন্দ্রীভূত ছিল। সাধারণ জনগণ দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং মুদ্রাস্ফীতির শিকার হতে থাকে, যা তাদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ সৃষ্টি করে।
২. দানা বাঁধে বিদ্রোহ
২০২৩ সালে রাস্তায় নেমে আসা ছাত্র ও তৃণমূল স্তরের আন্দোলন হাসিনা সরকারের পতনের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এই বিক্ষোভগুলো স্বচ্ছতা, গণতান্ত্রিক সংস্কার এবং দুর্নীতির অবসানের আকাঙ্ক্ষার দ্বারা পরিচালিত হয়ে ছাত্র, শ্রমিক এবং এমনকি মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি বিস্তৃত অংশের প্রতিনিধিত্ব করেছিল। যখন সরকার সহিংসতার সাথে এর প্রতিক্রিয়া জানায়, তখন এই বিদ্রোহ আরো জোরদার হতে শুরু করে।
৩. অভ্যন্তরীণ ফাটল এবং আন্তর্জাতিক চাপ
হাসিনার কর্তৃত্ববাদ যত গভীর হতে থাকে, আওয়ামী লীগের মধ্যে তত ফাটল বাড়তে থাকে। তার একক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দলীয় অনুগতদের অসন্তোষ সরকারকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দেয়। আন্তর্জাতিকভাবে হাসিনার সরকার ক্রমবর্ধমানভাবে বিচ্ছিন্নতার সম্মুখীন হয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন, রাজনৈতিক দমন-পীড়ন এবং নির্বাচনী জালিয়াতি পশ্চিমা গণতন্ত্রের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং বিশ্ব সম্প্রদায় তার শাসনব্যবস্থা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিতে শুরু করে ।
ফ্যাসিস্ট শাসনের অস্থিরতা
শেখ হাসিনার সরকার শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিল কারণ, সমস্ত ফ্যাসিবাদী বৈশিষ্ট্যগুলোর মতো এই সরকারও দমন, দুর্নীতি এবং সমাজের ওপর টেকসই নিয়ন্ত্রণের ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছিল। তার শাসন এবং ফ্যাসিবাদী শাসনের মধ্যে মিলগুলো স্পষ্ট: ক্ষমতার একত্রীকরণ, বিরোধীদের দমন, মিডিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ ও জাতীয়তাবাদ-এসবই তার শাসনের কর্তৃত্ববাদী প্রকৃতির দিকে ইঙ্গিত করে। কর্তৃত্ববাদ সহজাতভাবেই ভঙ্গুর। কারণ এটি ভয়, জবরদস্তি ও নিয়ন্ত্রণের ওপর নির্ভর করে। একবার তাতে ফাটল দেখা দিলে, যেমনটি হাসিনার শাসনামলে হয়েছিল, তখন স্থিতিশীলতা বজায় রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের জনগণ অন্যান্য ফ্যাসিবাদী শাসনামলের মতো অবশেষে পরিবর্তনের দাবি করেছিল, যার ফলে হাসিনার সরকারের পতন অনিবার্য হয়ে পড়ে।
হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসন থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক দলগুলোর যা করা উচিত:
১ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও প্রতিষ্ঠানকে সমুন্নত রাখা
রাজনৈতিক দলগুলোকে অবশ্যই বিচার বিভাগ, সংসদ ও সংবাদপত্রর অধিকারসহ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। একটি সুস্থ গণতন্ত্রের জন্য চেক এবং ব্যালেন্স নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে নিশ্চিত করতে হবে যাতে, কোনো একক নেতা অনিয়ন্ত্রিতভাবে আধিপত্য বিস্তার করতে না পারে ।
২. অন্তর্ভুক্তি ও নাগরিক অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করা
অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসন অত্যাবশ্যক। ভবিষ্যৎ দলগুলোকে সক্রিয়ভাবে সুশীল সমাজের সাথে যুক্ত করা উচিত। ভিন্নমতের কণ্ঠস্বর শুনতে হবে এবং সমস্ত জনগোষ্ঠীর থেকে অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করতে হবে। এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে হবে যেখানে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে ভিন্ন মতামতকে সম্মান করা হয় এবং সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা জোরদার করা হয়।
৩. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার প্রতিশ্রুতি
সরকারকে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করতে হবে। ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক দলগুলোকে উন্মুক্ত শাসনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া উচিত। নিশ্চিত করা উচিত যে সরকারি কর্মকর্তাদের তাদের কর্মের জন্য জবাবদিহি করা হবে। হাসিনার শাসনামলে দুর্নীতি ও কুসংস্কার ছিল প্রধান সমস্যা। দলগুলোর উচিত দুর্নীতিবিরোধী ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং হাসিনার শাসন থেকে শিক্ষা নিয়ে আর্থিক স্বচ্ছতা বজায় রাখা।
৪. সকলের জন্য আইন ও ন্যায়বিচার
একটি সুষ্ঠু ও স্বাধীন বিচার বিভাগ একটি কার্যকরী গণতন্ত্রের মেরুদণ্ড। রাজনৈতিক দলগুলোকে অবশ্যই আইনের শাসনকে সম্মান করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে যে আইনি ব্যবস্থা স্বাধীনভাবে কাজ করবে এবং রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নির্বিশেষে সকল নাগরিকের জন্য ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করবে। এটি বিচার ব্যবস্থায় নাগরিকদের বিশ্বাস পুনরুদ্ধারে সহায়তা করবে।
৫ সামাজিক কল্যাণে ফোকাস
ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক দলগুলোকে অবশ্যই অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য দূর করে নতুন নীতি প্রণয়ন করতে হবে। বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কথা মাথায় রেখে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিনিয়োগ। যা জাতির উন্নয়নকে শক্তিশালী করবে এবং জনগণের অসন্তোষকে রোধ করবে।
৬ সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে হবে
সরকারকে জবাবদিহি করতে মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক দলগুলোকে অবশ্যই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে যে সাংবাদিকরা সেন্সরশিপ, নিপীড়ন বা হয়রানির ভয় ছাড়াই যাতে কাজ করতে পারেন । হাসিনার অধীনে সংবাদপত্রের দমন, জনগণের অবিশ্বাস ও আন্তর্জাতিক সমালোচনার উদ্রেক করেছিল ।
রাজনৈতিক দলগুলোর যা করা উচিত নয়:
১. ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করা এড়িয়ে চলতে হবে
হাসিনার শাসনামলের অন্যতম প্রধান ত্রুটি ছিল একক কর্তৃত্বে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ, যা রাজনৈতিক প্রতিযোগিতাকে দমিয়ে দেয় এবং ব্যাপক দুর্নীতির দিকে পরিচালিত করে। রাজনৈতিক দলগুলিকে একজন নেতা বা সত্তার হাতে খুব বেশি ক্ষমতা ন্যস্ত করা এড়িয়ে চলতে হবে , কারণ এটি কর্তৃত্ববাদের জন্ম দেয় এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াগুলিকে দুর্বল করে।
২. রাজনৈতিক বিরোধী দলকে দমন করলে চলবে না
হাসিনার শাসনের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল আইনি কারসাজি, সহিংসতা এবং মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করা। ভবিষ্যত দলগুলোর উচিত সুস্থ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং বিরোধী শক্তির সাথে সংলাপকে উৎসাহিত করা, কারণ এটি গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে এবং নাগরিক অস্থিরতা প্রতিরোধ করে।
৩. কর্তৃত্ববাদী কৌশল প্রত্যাখ্যান করতে হবে
অধিকার কর্মী, সাংবাদিক ও বিরোধী সদস্যদের বিরুদ্ধে ভয় দেখানো, নজরদারি এবং রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট সহিংসতার প্রয়োগ এড়িয়ে চলতে হবে। এ ধরনের কৌশল গণতান্ত্রিক স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করে এবং ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে। রাজনৈতিক দলগুলোকে অবশ্যই নাগরিকদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ ও মত প্রকাশের অধিকারকে সম্মান করতে হবে।
৪. ব্যক্তিগত লাভের জন্য রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবহার এড়িয়ে চলতে হবে :
হাসিনার শাসনামলে দেখা যায় ব্যক্তিগত ও দলীয় লাভের জন্য রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যবহার জনগণের আস্থা নষ্ট করেছে। ভবিষ্যৎ দলগুলিকে নিশ্চিত করতে হবে যে সরকারি সংস্থানগুলো জনসাধারণের সুবিধার জন্য যাতে ব্যবহার করা হয়, রাজনৈতিক আনুগত্য রক্ষা বা শাসকগোষ্ঠীকে সমৃদ্ধ করার জন্য নয়।
৫. নির্বাচনী স্বচ্ছতা বজায় রাখতে হবে
নির্বাচনী কারসাজি ভোটের বৈধতা এবং আন্তর্জাতিক স্তরে দেশের অবস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক দলগুলোকে নিশ্চিত করতে হবে যে আগামী নির্বাচন যাতে অবাধ, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ হয়। জনগণের গণতান্ত্রিক পছন্দকে সম্মান করতে হবে।
৬. ব্যক্তিত্বের প্রচার করা এড়িয়ে চলতে হবে
হাসিনার শাসনব্যবস্থা এমন ব্যক্তিত্বের মোড়কে আবৃত ছিল যেখানে ভিন্নমতকে বিশ্বাসঘাতকতা হিসাবে দেখা হত। রাজনৈতিক দলগুলোকে অবশ্যই এমন পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে যেখানে নেতারাও সমালোচনা ও জবাবদিহির সম্মুখীন হবেন এবং তাদের ভুলগুলিকেও সামনে আনতে হবে।
শেখ হাসিনা সরকারের কাছ থেকে নেয়া শিক্ষাগুলো কর্তৃত্ববাদের সংকট এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের গুরুত্বের কথা তুলে ধরে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক দলগুলোকে অবশ্যই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান রক্ষা, অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রচার এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে। কর্তৃত্ববাদ পরিহার করে সুশাসনের নীতি গ্রহণ করলে রাজনৈতিক দলগুলো দেশের জন্য একটি সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারবে।
লেখক: যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়ার সাভানাহ স্টেট ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগের অধ্যাপক এবং সাবেক বিভাগীয় প্রধান।