বর্তমান প্রশাসনের বাস্তব অবস্থা ও করণীয়
নিজস্ব প্রতিবেদক, জনতার আওয়াজ ডটকম
প্রকাশের তারিখ:
শনিবার, আগস্ট ১৭, ২০২৪ ১১:৫৭ অপরাহ্ণ পরিবর্তনের তারিখ:
শনিবার, আগস্ট ১৭, ২০২৪ ১১:৫৭ অপরাহ্ণ
সেলিম মোহাম্মেদ
সরকার কাঠামোতে সরকারের নীতি বাস্তবায়নে আমলাতন্ত্র গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। সহজভাবে বলা হয় সরকার পরিবর্তনশীল কিন্তু আমলাতন্ত্র স্থায়ী। যেকোন সরকারের ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। স্বাধীনতার ৪১ বৎসরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। সব সরকারের আমলেই দেশীয় আমলাতন্ত্র নানা সীমাবদ্ধতা সত্তে¦ও দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ভুমিকা রেখে আসছে।
গত ১৫ বৎসরে বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রকে পূর্ণ ও বিকৃতভাবে রাজনীতিকরণ করা হয়েছে। এক কথায় আমলাতন্ত্র মূল অবয়ব হারিয়ে একদিকে দলীয় অন্যদিকে বিকৃত অবয়বে প্রকাশ লাভ করেছে। এ সময়ে নিয়োগ, পদোন্নতি, পদায়নের ক্ষেত্রে তথাকথিত নিরঙ্কুশ দলীয় ও ব্যক্তিগত লাভালাভের বিষয়গুলো গুরুত্ব পাওয়ায় আমলাতন্ত্রের মেরুদন্ড ভেংগে পড়েছে।
প্রশাসনের বর্তমান পরিস্থিতি
প্রশাসনকে শতভাগ দলীয়করণ করা হয়েছে।
প্রশাসনের চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে পড়েছে। কয়েকভাবে এর প্রভাব পড়েছে- একদিকে অধিদপ্তর, পরিদপ্তর সমূহ মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ মানছে না আবার জুনিয়র কর্মকর্তারা সিনিয়র কর্মকর্তাদের নির্দেশনা মানেন না।
প্রশাসনে সমন্বয় নেই। এর মাশুল দিতে হচ্ছে জনগনকে।
সরকারী কর্মকর্তারা জনবান্ধব হতে পারেনি, ফলে বারফবহপব নধংবফ ঢ়ড়ষরপু হচ্ছে না।
মন্ত্রণালয়সমূহ সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে, তারা তাকিয়ে থাকে প্রধানমন্ত্রির কার্যালয় থেকে কি নির্দেশনা আসে।
প্রায় সকল ক্ষেত্রেই সার্ভিস রুলস উপেক্ষিত হচ্ছে।
২০১৪,২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিনা ভোটের নির্বাচন, নৈশ ভোটের নির্বাচন ও জালিয়াতি’র নির্বাচনে সরকারী কর্মকর্তারা গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে সংবিধান বহির্ভূতভাবে কর্মসম্পাদন করে সংবিধান লংঘন করেছে। এক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ বাহিনীসহ অন্যান্য আইন-শৃংখলা বাহিনী, সিভিল প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের তৎকালীন কর্মকর্তাগণের ভুমিকা ছিল ঘৃণ্য ও দেশদ্রোহিতার শামিল। এ ধরণের কার্যক্রম সরাসরি সরকারী কর্মচারী’র শৃংখলা পরিপন্থি, রাষ্ট্র ও সংবিধান বিরোধী।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনসমূহেও সরকারী কর্মচারীদের কার্যক্রম ছিল অত্যন্ত গর্হিত ও জনবিরুদ্ধ।
বর্তমান সরকার অনেক নিবর্তনমূলক, নির্যাতনমূলক আইন তৈরী করেছে, উল্লিখিত পদধারীরা এসকল নিবর্তনমূলক আইন তৈরির সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত।
মানুষকে নির্যাতনের জন্য, মানবাধিকার, মুক্ত চিন্তা হরণের জন্য সরকার বিভিন্নভাবে সংবিধান লংঘন করেছে, এরা সকলেই সংবিধান লংঘনের কাজে সহায়তা করেছে।
সরকারের বিনা ভোটের নির্বাচন, সংবিধান বহির্ভুত কার্যকলাপের সাথে জড়িত থাকার কারণে সরকারী কর্মকর্তাদের একটা বড় অংশের মধ্যে ব্যাপকভাবে দূর্ণীতির প্রসার ঘটেছে।
সরকারী দল, প্রশাসন একাকার হয়ে সকল কিছুতে পারস্পরিক ইন্ধনে/মদদে যেভাবে খুশি সেভাবে নজিরবিহীনভাবে ক্রয় প্রক্রিয়ায় দৃষ্টিকটুভাবে অতিরিক্ত মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার লেশমাত্র কোথাও রাখা হয়নি।
অনেক অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এমন অনেক প্রকল্প নেয়া হয়েছে, যেগুলোতে শুধুই অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে আর কোন কাজ শুরু করা হয়নি, অনেক প্রকল্প নেয়া হয়েছে যেগুলোর পরিকল্পনা বিষয়ক ব্যপক ত্রুটি রয়েছে, এর মধ্যে অনেক প্রকল্পের বিষয়ে বর্তমান সরকারই বলছে ভুল হয়েছে আবার বলছে অনেক প্রকল্প ভেঙ্গে ফেলতে হবে। অনেক প্রকল্পে আবার বৈশি^ক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় দ্বিগুণ এমনকি তিনগুণ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
বর্তমানে যেভাবে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে
সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় মৌখিক পরীক্ষায় ২০০ নম্বর রাখায়, পিএসসি’র সকল সদস্যকে দলীয় ভাবধারায় বিশ^াসী দলীয় চিন্তাভাবনা থেকে নিয়োগ দেয়ার ফলে মৌখিক পরীক্ষায় দলীয় চিন্তাধারার বিষয়টি সামনে রেখে নম্বর প্রদান করা হয়। আবার গোয়েন্দা রিপোর্টে দলীয় আনুগত্য আছে কিনা সে বিষয়টিও বিবেচনা করা হয়। অন্যান্য নিয়োগের ক্ষেত্রে সরাসরি দলীয় এমপি বা দলীয় সভাপতির সুপারিশ লাগে। এর ফলে যারা মুক্ত/ নিরপেক্ষ কিংবা ভিন্ন ভাবধারার মানুষ তাদের অনেকে নীতি/আদর্শ বিসর্জন দিয়ে মিথ্যা তথ্য প্রদান, নতজানু হয়ে দলীয় এমপি কিংবা সভাপতির সুপারিশ নিতে পারেনি তাদের নিকট শুধু সরকারী চাকরি নয়, সরকার কর্তৃক প্রদত্ত ব্যাবসা-বাণিজ্য থেকেও বঞ্চিত থেকেছে।
পদায়ন/পদোন্নতি
পদায়ন ও পদোন্নতির প্রথম শর্ত সরাসরি আওয়ামী ভাবধারার হতে হবে।
দ্বিতীয়তঃ যারা পারিবারিকভাবে আওয়ামী ভাবধারার নয় তারা আওয়ামী ভাবধারায় পরিবর্তিত হয়েছে মর্মে এমপি/মন্ত্রির উপানুষ্ঠিক পত্র/সুপারিশ আনয়ন; অনেকে আবার বছরব্যাপি শেখ মুজিবের ছবি বুকে লাগিয়ে চলাফেরা করা, কথায় কথায় মুজিব বন্দনা, শেখ মুজিবের মাজার জিয়ারতের ছবি তুলে তা ব্যাপকভাবে প্রচার এবং এর সাথে অর্থের লেন-দেন করা।
এর ফলে দ্বিতীয় আংগিক বিবেচনায় যারা পদোন্নতি পেয়েছেন, তারা সরাসরি নীতি বিসর্জন দিয়েছে, মানসিকভাবে মননে অনৈতিকতা ধারণের ফলে তাদের মধ্যে ভিতরগত একটা অবক্ষয় ঘটে গেছে। এছাড়াও এদের সাথে আওয়ামী দলীয় অবস্থার সাথে অশুভ সংযোগ ঘটার ফলে স্বাভাবিকভাবে ধরে নেয়া যায় এ সংযোগটি তারা অনেকটা বাধ্য হয়েই সম্পর্কটি ধরে রাখবে। এধরণের ক্ষেত্রে সম্পর্ক রক্ষা না করলে ব্ল্যাকমেইল হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।
সাধারণভাবে যারা সরকারের অনৈতিক, দূর্ণীতিমূলক, অসাংবিধানিক, জনবিরুদ্ধ কার্যকলাপের সাথে জড়িত
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যারা পদোন্নতি পেয়েছে (গুটি কয়েকজন বাদে), সরকারের নীতিনির্ধারণী পদ (বর্তমান প্রেক্ষাপটে অতিরিক্ত সচিব থেকে তদুর্ধ সকল পদ সরকারের নীতি নির্ধারণী পদের অন্তর্গত), মন্ত্রণালয়ের/ অধিদপ্তর সমূহের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ সিনিয়র সহকারী সচিব, উপসচিব, যুগ্মসচিব বা সমমর্যাদার পদ, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের পদ, সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত (ফ্রিঞ্জ বেনিফিট) পদ, বিভিন্ন প্রকল্পের জাতীয় প্রকল্প পরিচালক, প্রকল্প পরিচালক, অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক, অধিদপ্তরসমূহের মহাপরিচালক/চেয়ারম্যানের সকল পদ, মন্ত্রী ও মন্ত্রীর পদমর্যাদাধারীগণের একান্ত সচিব/সহকারী একান্ত সচিব, সকল সচিব, সচিব এবং সচিব ও সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাগণের একান্ত সচিব/সহকারী একান্ত সচিব, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, গুরুত্বপূর্ণ জেলাসমূহের অতিরিক্ত জেলাপ্রশাসক, গুরুত্বপূর্ণ উপজেলাসমূহের ইউএনও, সহকারী কমিশনার (ভুমি) এবং যারা ২০১৪ এর বিনা ভোটের নির্বাচন,২০১৮ সালের রাতের ভোটের নির্বাচনে সহায়তা প্রদানকারী কর্মকর্তা ও ২০২৪ এর জালিয়াতি নির্বাচনের সহায়তাকারী কর্মকর্তা।
প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ব্যাক্তিসত্ত্বায় যা লক্ষ্যণীয়
কর্মকর্তারা ভীত-সন্ত্রস্ত, নতজানু, ক্ষয়প্রাপ্ত, দূর্নীতিপরায়ন, কেউ কেউ আবার নিষ্ক্রিয় (চধংংরাব) দূর্ণীতিপরায়ন ও মেরুদন্ডহীন হয়ে পড়েছে।
চিন্তা-চেতনায় দ্রুত ধনী হওয়ার মানসিকতা পেয়ে বসেছে।
মানসিকভাবে স্বপ্নহীন জড়পদার্থের আচরণে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।
এরা সকলে দুষ্ট চক্রের সাথে এমনভাবে জড়িয়েছে ফলে সবসময় তাদেরকে ভয় তাড়া করছে।
এ অবস্থায় বর্তমান প্রশাসন বহাল রাখলে
প্রশাসনের সকল তথ্য পাচার হয়ে যাবে।
যেহেতু এরা সকলেই দুষ্ট চক্রের সাথে সংশ্লিষ্ট, ফলে তারা সবসময়েই ভীত সন্ত্রস্ত থাকবে।
দূর্নীতি যেহেতু এদের মজ্জ¦াগত স্বভাবে পরিণত হয়েছে সেজন্য দূর্নীতির চক্র থেকে এরা বের হতে পারবে না।
আওয়ামী দুষ্টচক্র ও সিন্ডিকেটের সাথে এদের যোগাযোগ থেকেই যাবে।
এ অবস্থার নিরসনকল্পে
আপাতঃভাবে যে সকল কর্মকর্তাকে ভিন্ন মতের কারণে পদোন্নতি/পদায়ন থেকে বিরত রাখা হয়েছে এদের মধ্যে যারা বাধ্য হয়ে সরকারী চাকরি থেকে পদত্যাগ করেছে, যারা স্বাভাবিক অবসর গ্রহণ করেছে, যাদেরকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়েছে- তাদের মধ্য থেকে সৎ,দক্ষ ও শুদ্ধ চিন্তার কর্মকর্তাদেরকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে (অন্ততঃ ৫০ থেকে ৬০ ভাগ) পদায়ন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে (এক্ষেত্রে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে আইনগত কোন বাধা নেই)।
রাষ্ট্রের সকল সেক্টরে জনমুখী সংস্কার আনয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ
সেক্টরসমূহে কি অনুপাতে এবং কি ধাচের দূর্নীতি হয়েছে তা চিহ্নিত করে জনসমক্ষে প্রকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ।