বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের নেপথ্যে ব্যালটের ভূমিকা অনন্য
নিজস্ব প্রতিবেদক, জনতার আওয়াজ ডটকম
প্রকাশের তারিখ:
শনিবার, এপ্রিল ২২, ২০২৩ ৪:৪০ অপরাহ্ণ পরিবর্তনের তারিখ:
শনিবার, এপ্রিল ২২, ২০২৩ ৪:৪০ অপরাহ্ণ

ডেস্ক নিউজ
একটি নির্বাচন। একটি জাতির জন্ম। শুরুটা বহু আগে। ৫২, ৬৬, ৬৯। ইতিহাসের পরিক্রমা। ৭ই ডিসেম্বর, ১৯৭০। সোনার হরফে লেখা দিন। যেদিন এই ভূমের মানুষই প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তান রাষ্ট্রের মৃত্যু ঘোষণা করেন। জানান দেন, একটি নতুন পতাকার অভ্যুদয় কেবলই সময়ের ব্যাপার। ব্যালট বিপ্লব কথাটা অতি ব্যবহারে মাঝে মাঝে ক্লিশে শোনায়।
কিংবা এই শব্দের হয়তো ওতোটা শক্তিও নেই ‘স্বাধীনতার’ মাহাত্ম্য বর্ণনা করে। তবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের নেপথ্যে ব্যালটের ভূমিকা অনন্য। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক জয়। ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা, ষড়যন্ত্র। নিষ্ঠুর গণহত্যা। মানুষের প্রতিরোধ। অতুলনীয় ত্যাগ। সশস্ত্র যুদ্ধ। স্বাধীনতা, বিজয়। নতুন দেশ, নতুন মানচিত্র। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে পূর্ণতা।
এথেন্স থেকে বাংলাদেশ। প্রত্যক্ষ থেকে পরোক্ষ। গণতন্ত্রের ইতিহাস দীর্ঘ। অপারেশন থিয়েটারে কাটাছেঁড়াও কম হয়নি। গণতন্ত্র কি মারা যাচ্ছে-এই প্রশ্নও উঠেছে। কিন্তু এত কিছুর পরও শিকড়ে কোনো পরিবর্তন নেই। গণতন্ত্রের আদিতে মানুষ, অন্তেও মানুষ। ‘জনগণই সকল ক্ষমতার মালিক’ এটিই গণতন্ত্রের প্রধান কথা। তাহলে গণতন্ত্রের প্রথম কথা কী? অবশ্যই ব্যালট। যদিও এ নিয়ে অনেক কথা হবে। সে যাই হোক, ব্যালট যে কেবল মানুষকে ক্ষমতায়িত করে তাই নয়, ব্যালটের আরেকটি প্রধান ভূমিকাও রয়েছে। এক্ষেত্রে আমরা স্মরণ করতে পারি প্রয়াত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেমস বিউকানানের ঐতিহাসিক উক্তি-‘মুক্ত মানুষের মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তির সবচেয়ে উত্তম মাধ্যম ব্যালট।’
১৯৭৩-২০১৮। নানা কিসিমের ভোট দেখেছে এ দেশের মানুষ। কখনো জনগণ ছিলেন একদিনের বাদশা। অবাধে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। কখনো বা গিয়ে শুনেছেন তাদের ভোট দেয়া হয়ে গেছে। কখনো যাওয়ার সুযোগও পাননি। ‘হ্যা’ ‘না’ ভোটের নজিরও দেখেছে বাংলাদেশ। পাঠকের মতো ব্যালটেরও মৃত্য হয়েছে বার বার। হাল-জমানায় সবচেয়ে আলোচিত হচ্ছে ‘রাতের ভোট’।
কড়া নাড়ছে আরেকটি নির্বাচন। কেমন হবে সে নির্বাচন। এরইমধ্যে শুরু হয়েছে তর্ক-বিতর্ক। অনড় প্রধান দুই রাজনৈতিক শিবির। জনগণের মধ্যে অবশ্য আগ্রহ কম। তারপরও বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন, কেমন হবে সে নির্বাচন? ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি? নাকি রচিত হবে নয়া ইতিহাস?

আমার ভোট আমি দেবো
১৯৭৯ সালে মার্কিন বুদ্ধিজীবী ফুকোইয়ামা ‘The End of History’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। এতে তিনি দেখান যে, স্নায়ুযুদ্ধের শেষে ইতিহাস তার পূর্ণতা লাভ করেছে। উদার গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতামূলক দ্বন্দ্ব চলছিল। স্নায়ুযুদ্ধের অবসানে উদার গণতন্ত্র জয়ী হয়েছে। তার এই বক্তব্যের সঙ্গে অবশ্য দ্বিমত পোষণ করেছেন প্রয়াত ড. আকবর আলি খান। তিনি তার ‘অবাক বাংলাদেশ: বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি’ বইয়ে লিখেছেন, ‘গণতন্ত্র জয়যুক্ত হয়েছে, ফুকোইয়ামার এ বক্তব্য সঠিক নয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পৃথিবীর অনেক দেশেই এখনো চূড়ান্ত রূপ নেয়নি। উপরন্তু দেশভেদে গণতন্ত্রের রূপও ভিন্ন। কাজেই সমাজতন্ত্রের পরাজয় ঠিকই হয়েছে কিন্তু গণতন্ত্রের চূড়ান্ত বিজয় এখনো হয়নি। পৃথিবীর সর্বত্র গণতন্ত্র নিয়ে নানা নিরীক্ষা চলছে।’
এ নিয়ে কথা চলতেই থাকবে। ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক। গণতন্ত্রের জন্ম প্রাচীন গ্রিসে। তবে খ্যাতিমান গ্রিক দার্শনিকরা এ ব্যবস্থা মোটেই পছন্দ করতেন না। তারা মনে করতেন, এ ব্যবস্থায় দরিদ্র এবং অমার্জিতরা নেতা হন। গ্রিসের নগররাষ্ট্র এথেন্সে জারি হওয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছিল প্রত্যক্ষ। সেখানে শাসনব্যবস্থায় জনগণ সরাসরি মতামত দিতেন। সভ্যতা এগিয়ে গেছে। নগররাষ্ট্র থেকে মানুষ গড়ে তুলেছে বৃহৎ রাষ্ট্র। বৃহৎ রাষ্ট্রে চাইলেও প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র চর্চা সম্ভব নয়। চালু হয়েছে পরোক্ষ গণতন্ত্র। এর কেতাবি নাম দেয়া হয়েছে প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থা। যেখানে জনগণের পক্ষে তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ক্ষমতার চর্চা করে থাকেন। বলা হয়, নির্বাচনের মাধ্যমে এ ব্যাপারে তারা জনগণের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছেন। তবে বড় কিংবা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে জনগণের মতামত নেয়ার জন্য বিভিন্ন দেশে গণভোটের ব্যবস্থাও চালু রয়েছে। পৃথিবীর ৫০টির বেশি দেশে এ ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে। আমাদের সংবিধানেও আগে গণভোটের বিধান ছিল। পরে তা তুলে দেয়া হয়।
এথেন্সের গণতন্ত্র ছিল উদার। তবে বর্তমান বিশ্বে নানা কিসিমের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা জারি রয়েছে। লন্ডনের দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকা গণতন্ত্রের সূচক প্রকাশ করে থাকে। পত্রিকাটির ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চলমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ৪টি ভাগে বিভক্ত করেছে। ১. পূর্ণ গণতন্ত্র ২. ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র ৩. হাইব্রিড রেজিম ৪. স্বৈরতন্ত্র। বাংলাদেশ রয়েছে হাইব্রিড রেজিমের তালিকায়। ফরিদ জাকারিয়া উদার গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে লিখেছেন, “A political system marked not only by free and fair elections, but also by the rule of law, a separation of power and protection of basic liberty of speech, assembly, religion and property.’’
বাংলাদেশে এখনো ভোটাধিকার নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। প্রিয় পাঠক আবার বিভ্রান্ত হবেন না। বাংলাদেশে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রাপ্তবয়স্ক যেকোনো লোকেরই ভোটার তালিকায় নাম তোলার অধিকার রয়েছে। এ নিয়ে কোনো বাধার মুখেও পড়তে হয় না। এখানে প্রশ্নটা থেকে যায় ভোটাধিকার প্রয়োগ নিয়ে। তবে সর্বজনীন ভোটাধিকার পেতেও দেশে দেশে সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। প্রথম নারী ও পুরুষের সর্বজনীন ভোটাধিকার স্বীকৃত হয় নিউজিল্যান্ডে ১৯০৭ সালে। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও শুরুর দিকে কৃষাঙ্গ ও নারীদের ভোটাধিকার ছিল না। মার্কিন জনগণ আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমেই এ অধিকার অর্জন করে। তবে যেটা আগেই বলেছি কাগজে-কলমে ভোটাধিকারই যথেষ্ট নয়। ভোটারের তা প্রয়োগ এবং তার ভোট যেন গননা করা হয় সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। বৃটিশ নাট্যকার টম স্টপারের বক্তব্য এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য- ‘শুধু ভোটের ব্যবস্থা থাকলেই গণতন্ত্র হয় না। কীভাবে ভোট হিসাব করা হবে, তার ওপরই নির্ভর করে ভোটের ফলাফল।’

স্বাধীনতার রায়
এটা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের উত্থানপর্ব। একটি রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের সময়। ৬ দফা থেকে উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান। আইয়ুব শাহীর পতন। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক উত্থান। ১৯৭০ সালের নির্বাচনই আসলে ঠিক করে দেয় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের গতিরেখা।
১৯৬৯ সালের মার্চ মাসে আইয়ুব খানের পতনের পর সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খান মার্শাল ল’ জারি করেন। জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন তিনি। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের অন্যতম উপদেষ্টা জি. ডব্লিউ চৌধুরী দাবি করেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের প্রবল আগ্রহ ছিল প্রেসিডেন্টের। ১৯৭০ সালের ৭ই জুন আওয়ামী লীগ আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনের প্রচারাভিযান শুরু করে। ভোটের পুরো হাওয়া ছিল বঙ্গবন্ধুর পক্ষে। ৬ দফা থেকে গণঅভ্যুত্থান। জনপ্রিয়তা তখন তার তুঙ্গে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমেদ উল্লেখ করেছিলেন, জাতীয় পরিষদের ১৬২টি আসনের মনোনয়নের জন্য আবেদন পড়ে ৩৫৯টি। প্রচারাভিযানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোনার বাংলা গড়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। একটি পোস্টারের স্লোগান তখন বিপুল আলোড়ন তুলেছিল। ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন?’ ‘শতাব্দী পেরিয়ে’ বইয়ে হায়দার আকবর খান রনোর দেয়া মতে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, আওয়ামী লীগ ও ৬ দফার পক্ষে যে জোয়ার উঠেছিল, তার সামনে দক্ষিণপন্থি দলগুলো দাঁড়াতেই পারছিল না। ওই নির্বাচনে ২৪টি দল অংশ নেয়। ইয়াহিয়া খান সরকারের মন্ত্রিসভার কোনো সদস্যের ওই নির্বাচনে অংশ নেয়ার অনুমতি ছিল না। জি. ডব্লিউ চৌধুরীর দাবি, ওই নির্বাচন সত্যিকার কেয়ারটেকার সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
ভোটের ফল ছিল অনেকটা অনুমিত। পূর্ব পাকিস্তানে ১৬২টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬০টি আসনে জয়লাভ করে। মহিউদ্দিন আহমদ তার ‘জাসদের উত্থান-পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি’ বইয়ে লিখেছেন, ‘এত দিন চিন্তা ছিল নির্বাচন হবে কি হবে না। নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর তার ফলাফলে এমন মেরুকরণ ঘটলো যে, তা পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভিত্তিমূল রীতিমতো ঝাঁকিয়ে দিলো।’
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করে। ক্ষমতা ভাগাভাগির মতো অদ্ভুত আবদার শোনা যায়। জোরদার হয় স্বাধীনতার আন্দোলন। ৭ই মার্চ, ১৯৭১ চূড়ান্ত বার্তা দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ২৫শে মার্চ গণহত্যা চালায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। শুরু হয় স্বাধীনতার যুদ্ধ, মুক্তির যুদ্ধ। বহু জীবন আর ত্যাগের বিনিময়ে আসে চূড়ান্ত বিজয়। ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেশে ফেরার মধ্যদিয়ে পূর্ণতা পায় যা। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের ‘বিপুলা পৃথিবী’ বইয়ে সে সময়ের একটা বর্ণনা পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, যে পথে যাচ্ছি, তার দু’পাশের বাড়িঘরে গোলাগুলির চিহ্ন; ভাঙা পুল; বিকল্প পথ; পাকিস্তানিদের তৈরি বাঙ্কার; ভারতীয় বা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ছোটোখাটো ছাউনি। লোকজন কিছু কিছু ফিরছে তখনো; বিধ্বস্ত ঘরের পাশে তুলছে নতুন আশ্রয়; দোকানপাট সাজাচ্ছে নতুন করে। ফুলতলার কাছে পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত একটি ট্যাংক পড়ে আছে। সেদিকে কেউ কেউ কৌতূহলী দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে মাত্র।
খুলনায় বোনের বাড়িতে দু’দিন কাটিয়ে ৮ তারিখে আবার দুই গাড়ির বহর ঢাকার পথে। এবারো মেজো দুলাভাই আছেন আমাদের গাড়িতে। ঢাকার পথ অনেক বেশি দুর্গম মনে হলো। ভাঙা হাডিঞ্জ ব্রিজের নিচ দিয়ে ফেরিতে নদী পার হলাম। কোথাও নৌকাজুড়ে পন্টুনের মতো করা হয়েছে; তার উপর দিয়ে গাড়ি পার করার ব্যবস্থা। কোথাও ঝুড়ি-কোদাল নিয়ে মজুররা কাজ করছে তখনো, ইট জোগাচ্ছে গাড়ির চাকার নিচে। জায়গায় জায়গায় অনেকক্ষণ দেরি হচ্ছে-বেশ ভিড় জমে যাচ্ছে। যেসব জায়গায় এমন ভিড় সেখানে দোকানো খুলে বসেছে কেউ কেউ। দোকানে রেডিও বেজে চলেছে সর্বক্ষণ। তখনো সন্ধ্যা হয়নি। এই রকম অপেক্ষায় আছি অনেকে। হঠাৎ জনতার মনে চাঞ্চল্য, উল্লাস ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি। কী হয়েছে? বেতারে সংবাদ; বঙ্গবন্ধু মুক্তি পেয়েছেন পাকিস্তানের কারাগার থেকে।
নানা কিসিমের ভোট
১৯৭৩ থেকে ২০১৮। কতো রকম ভোটই না দেখেছে এদেশের মানুষ। ক্ষমতাসীনরা কখনো তাদের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে হারেনি। এই একটি তথ্যই খোলাসা করে দেয় সবকিছু। রাজপথে আন্দোলন, পর্দার আড়ালে সমঝোতায় আসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। একেবারেই নিজস্ব আবিষ্কার। অবাধ নির্বাচনের একটা পথ খোলা হয়। পরে তাও বিতর্কের বাইরে থাকেনি। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে মৃত্যু হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার।
গত দু’টি নির্বাচন নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা। একটিতে ওয়াক ওভারই পায় আওয়ামী লীগ। অন্যটি নজিরবিহীন। এতটাই যে, ঢাকায় নিযুক্ত জাপানি রাষ্ট্রদূতও আগে কখনো এমন ভোটের কথা শোনেননি। রাতের ভোট শব্দযুগল তো এখন খুবই জনপ্রিয়। সম্ভবত, সারা দুনিয়াতেই আমরা এর উদ্ভাবক।
ভোট তো কেবল সিল বা আঙুলের টিপ নয়, আদতে এটি জনগণের ক্ষমতা চর্চার প্রধান প্রতীক। জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদে বলা হয়েছে, ‘The Will of the people shall be the basis of The authority of the government, this will shall be expreesed in periodic and genuine elections which shall be universal and equal suffrage and shall be held by secret vote or by equivalent free voting procedures’.
তবে জাতিসংঘ বলে দিলেই তো আর জেনুইন ভোট হয় না। দেশে দেশে ইতিহাস তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। উন্নয়ন, উন্নয়ন বলে মানুষকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার কাহিনীও কম নয়। যদিও অমর্ত্য সেন বলছেন উন্নয়ন হচ্ছে- ‘বাস্তবে মানুষ যে স্বাধীনতা ভোগ করে, তার সম্প্রসারণের প্রক্রিয়া।’
তত্ত্ব কথা অনেক হলো। এবার বাস্তবে ফিরে আসা যাক। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের কথা শুনে মনে হয় বাস্তব পরিস্থিতি তিনি অনুধাবন করতে পেরেছেন। সম্প্রতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, ‘ইভিএম বা ব্যালট কিন্তু আমাদের নির্বাচনের মোটেই বড় চ্যালেঞ্জ নয়। আমাদের নির্বাচনের সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে রাজনৈতিক সংকট। প্রধান দলগুলো অংশগ্রহণ করবে কি করবে না, সেটা হচ্ছে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। ইভিএম সংশ্লিষ্ট শুধু পোলিং প্রসেসের সঙ্গে। আর নির্বাচনে যদি বড় দলগুলো একেবারেই অংশগ্রহণ না করে নির্বাচনের লিগ্যালিটি নিয়ে কোনো সংকট হবে না, তবে লেজিটিমেসি শূন্যের কোঠায় চলে যেতে পারে।’ দৃশ্যত প্রধান নির্বাচন কমিশনার তার অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন। কথা হচ্ছে, একটি অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের উপায় কী? যে যাই বলুক নির্বাচন কমিশনের তো আসলে এ নিয়ে তেমন কিছু করার নেই। চাবি রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে।
ব্যালট কথা বলে
দরজায় নির্বাচন। নিশ্চয়তা-অনিশ্চয়তা। বনানী-গুলশান-আগারগাঁওয়ে যা টুকটাক ভোটের আলাপ। অন্যত্র অদ্ভুত
নীরবতা। নানা গুজব। ইলেকশন, নো-ইলেকশন। সক্রিয় আন্তর্জাতিক শক্তি। তারা অবশ্য বিভক্ত। একপক্ষ অবাধ নির্বাচনের পক্ষে সরব। দুই পরাশক্তি মনে করে, এসব বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। আরেক বড় শক্তি মুখে কিছু বলে না। কিন্তু কে না জানে তাদের অবস্থান! আওয়ামী লীগ-বিএনপি যথারীতি অনড়। সমঝোতার পথে কেউই হাঁটছেন না। নিরপেক্ষ বিশ্লেষকরা বলছেন, সামান্যতম স্বচ্ছ নির্বাচন হলে সরকার হেরে যাবে। তাদের ১৫ বছরের অপশাসন মানুষকে ক্ষুব্ধ করেছে। ভোটের প্রতি আস্থা হারিয়েছে। বিরোধী বিএনপিকে পয়েন্ট অব নো রিটার্নে ঠেলে দিয়েছে। এক বিতর্কিত মামলায় বিরোধী নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে জেলে রাখা হয়েছে। চাপ বাড়ছে তাকে মুক্ত করার। সরকার বলছে তাদের কিছু করার নেই। আদালতের উপর তাদের কোনো হাত নেই। যে যাই বলুন না কেন বেগম জিয়া এখনো বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নিয়ামক শক্তি। এবারের নির্বাচনেও তাকে ঘিরে সবকিছু আবর্তিত হবে। দিন শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি অংশগ্রহণমূলক কোন নির্বাচন দিতে সম্মত হবেন? সরকার মনে করে এটা হবে তাদের জন্য মস্তবড় ঝুঁকি। হারার মানসিকতায় নেই তারা। এই অবস্থায় সামনের দিনগুলো হবে উত্তেজনায় ভরা। বলে রাখা ভাল, এবারের নির্বাচন শুধু বাংলাদেশের নয়, ভূরাজনীতি এখানে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে। যাই হোক বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন হচ্ছে, কেমন হবে আগামী নির্বাচন। এখন পর্যন্ত তা চেনা ছকেই এগুচ্ছে। একতরফা। বিরোধীরা কি পারবেন, দাবার চাল উল্টে দিতে। সহজ নয়। অনেক কঠিন। রাষ্ট্রশক্তি বলে কথা। ঘরের ভেতরেও রয়েছে বিশ্বাস-অবিশ্বাস। নাগরিক সমাজ? তারা এখন নেই বললেই চলে। এতসব যাঁতাকলে পড়ে ব্যালটের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। সে তার মালিকের কাছে ফিরে যেতে চায়। যেই জিতুক, হারুক তার কিছু আসে যায় না। সে চায় তার গায়ে যেন কলঙ্কের দাগ না লাগে। কিন্তু নিশ্চিত করেতো আসলে কিছুই বলা সম্ভব নয়। স্মরণ করি রবীন্দ্রনাথকে, ‘পথের শেষ কোথায়, শেষ কোথায়, কি আছে শেষে।’ সূত্রঃ মানবজমিন
জনতার আওয়াজ/আ আ
