বিদেশীদের যাতায়াত : কূটনীতির ঘোর অন্ধকার – জনতার আওয়াজ
  • আজ সকাল ১০:৪৪, শুক্রবার, ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৫ হিজরি
  • jonotarawaz24@gmail.com
  • ঢাকা, বাংলাদেশ

বিদেশীদের যাতায়াত : কূটনীতির ঘোর অন্ধকার

নিজস্ব প্রতিবেদক, জনতার আওয়াজ ডটকম
প্রকাশের তারিখ: রবিবার, আগস্ট ৬, ২০২৩ ১:৩২ পূর্বাহ্ণ পরিবর্তনের তারিখ: রবিবার, আগস্ট ৬, ২০২৩ ১:৩২ পূর্বাহ্ণ

 


রিন্টু আনোয়ার

কখনো একা, কখনো প্রতিনিধিদল নিয়ে বিভিন্ন দেশের হাই-প্রোফাইলরা আসছেন, আরো আসবেন। অসহ্য লাগলেও সরকারের এখন আর তাদের রোখার অবস্থা নেই। এক্সিলেন্সিদের আদর-সমাদর, তোয়াজ-তোষণ ছাড়া গতি নেই। তাদের সঙ্গে বৈঠক, ফটোসেশন করে বলতে হচ্ছে, বড় মধুর সম্পর্কের কথা। দাবি করতে হয়, বিএনপির সঙ্গে নয়, তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে আছে। সরকারের কার্যক্রমে বড় খুশি তারা। এ ধরনের সার্কাসের মধ্যে এখন আর যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা কয়েকটি দেশ নয়; বিশ্বসভা জাতিসঙ্ঘও বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের তাগিদ দিচ্ছে।

সুষ্ঠু নির্বাচনের যেকোনো তাগিদ সরকারের বড় অপছন্দ। বিএনপিকে নির্বাচনে এনে দিতে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারস্থ হওয়ার কথা দেশটি সফরের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন কৃতিত্ব জাহিরের মতো। ভারতের সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক দাবি করে বলেছেন, ভারতকে তিনি অনুরোধ করেছেন তারা যেন আওয়ামী লীগকে আবার ক্ষমতায় রাখে। এসব করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরকারের কাছে তার অ্যাচিভমেন্ট উপস্থাপন করতে পেরেছেন। সরকারের বিদেশনীতির অবস্থাও প্রকাশ করেছেন। সেই বিদেশী রাষ্ট্রগুলোর সুষ্ঠু নির্বাচনের তাগিদ তাদের ভালো লাগে না। কিন্তু, সহায়তা বা পাশে আছে-থাকবে জানালে বড্ড খুশি। আগামীতেও একতরফা নির্বাচনে সায় দেবে ইঙ্গিত মালুম হলে বিদেশীরা উন্নয়ন সহযোগী, পরম বন্ধুসহ আরো কত কিছু হয়ে যায়। সমস্যাটা এখানেই। অবস্থা আগের জায়গায় নেই। বাংলাদেশে জাতিসঙ্ঘের শান্তিপূর্ণ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের তাগিদের মধ্যে সেই বার্তা পরিষ্কার।

এটি আরও পরিষ্কার করেছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। প্রধান নির্বাচন কমিশনার-সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ঘণ্টাব্যাপী। কিছুক্ষণ আবার রুদ্ধদ্বার। ইসিতে বৈঠক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস ফেসবুকে পোস্টে জানিয়েছে, বৈঠকে রাষ্ট্রদূত হাস গণতন্ত্র এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের প্রতি অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন। অক্টোবরের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র আগাম নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে, সেই বার্তাও দিয়ে এসেছেন। এর জেরে প্রধান নির্বাচন কমিশনার, সঙ্কট সমাধানে রাজনৈতিক দলগুলোকে এক টেবিলে বসার আহ্বান জানান।

বিএনপিসহ বেশির ভাগ বিরোধী দল এখন নিরপেক্ষ-সুষ্ঠু নির্বাচন দাবিতে প্রায় কাছাকাছি এসেছে। তত্ত্বাবধায়কের অধীনে নির্বাচন দাবিতে সিপিবি, জামায়াতও কাছাকাছি। সরকারের সঙ্গে রাজনীতির মাঠে আছে কেবল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দল। নেতিয়ে পড়া জোটটিকে সম্প্রতি মাঠে নামিয়েছে সরকার। তাদের মূল কাজ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিরুদ্ধে বিষোদগার।

এখানেও একটি বার্তা ঘুরছে। শান্তিপূর্ণ, গ্রহণযোগ্য ও সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলছে বাংলাদেশের বাম, ডান, মধ্য-বাম এবং মধ্য-ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ, এমনকি জাতিসঙ্ঘও। তাদের ডিঙিয়ে ক্ষমতাসীনরা ২০১৪ এবং ২০১৮ ধরনের নির্বাচন করতে পারবে কি না- প্রশ্ন সেখানেই। আন্তর্জাতিক অঙ্গন এবার আগেভাগেই তৎপর। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের কোনো ঘটনাই তাদের নজর এড়াচ্ছে না। রাজনৈতিক বিক্ষোভ ঘিরে সহিংসতায় তারা উদ্বেগ জানিয়েছে। সরকারকে সহিংস ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্ত এবং অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে বলেছে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিশ্বে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর মতও এমন। সবার চোখ বাংলাদেশের দিকে। তাদেরকে বাংলাদেশ চেনানোর কাজটি আজকের ক্ষমতাসীনরাই করেছেন। এক সময় যেকোনো ইস্যুতে তারা ছুটে যেতেন সেখানে। ওইসব সংগঠনের একটি বিবৃতি বা প্রতিক্রিয়া আদায়ের হেন চেষ্টা-তদ্বির-লবিং নেই যা না করা হয়েছিল। এখন তারা নিয়মিতই বাংলাদেশকে চেনে। নিয়মিত বিবৃতি দেয়। ২৯ জুলাই ঢাকার সহিংসতার ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে অ্যামনেস্টি বলেছে, এর প্রভাব নির্বাচনের আগে, নির্বাচনের সময় ও পরবর্তীতে মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর পড়তে পারে। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে একের পর এক আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর বিবৃতি বিশ্বগণমাধ্যমেও জায়গা পাচ্ছে। আগস্টের দ্বিতীয় দিন বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে নিউ ইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এইচআরডব্লিউর বিবৃতির ভাষা বড় তেজি।

এতে বলা হয়: বাংলাদেশ পুলিশ নির্বিচারে রাবার বুলেট, টিয়ার গ্যাস এবং জল কামান ব্যবহার করেছে এবং ২০২৩ সালের জুলাইয়ের শেষের দিকে বিক্ষোভের সময় বিরোধী দলের সমর্থকদের লাঠিপেটা করেছে। এরকম সময়ে সেরের ওপর সোয়া সের দিয়ে বসেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ১৪ কংগ্রেসম্যান। জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে বাংলাদেশের সদস্যপদ স্থগিতে অবিলম্বে পদক্ষেপ গ্রহণ, শান্তিরক্ষা মিশনে র‌্যাবের মানবাধিকার হরণকারীদের নিষিদ্ধ এবং জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে ও পরিচালনায় নির্বাচনের আহ্বান জানিয়ে জাতিসঙ্ঘে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত লিন্ডা টমাস গ্রিনফিল্ডকে চিঠি দিয়েছেন তারা।

শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের সহিংসতার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে চিঠিতে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বর্তমান সরকারের অধীনে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন পর্যালোচনা করে আন্তর্জাতিক অঙ্গন এবার আগেভাগেই সতর্কতার জাল ফেলছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, নির্বাচন সামনে আসার সাথে সাথে, আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে বল প্রয়োগের নিয়মগুলো মেনে চলার জন্য কর্তৃপক্ষের উচিত পুলিশকে নির্দেশ দেয়া এবং স্পষ্ট করা যে, যারা এই মানগুলো লঙ্ঘন করবে তাদের জবাবদিহি করা হবে। ইইউর বিশেষ প্রতিনিধি গিলমোরের ঢাকা সফরকালের বক্তব্যও সরকারের জন্য কঠিন বার্তা। তিনি বলেছেন, ‘আমরা শুধু নির্বাচনের দিকে তাকাই, ভোটের দিন কী হয় তা আমরা দেখি না। এবার যেকোনো নির্বাচনের পূর্ববর্তী পরিবেশ, রাজনৈতিক দলগুলোর পরিস্থিতি, রাজনৈতিক বিতর্ক, মিডিয়া এবং নির্বাচন আয়োজনের জন্য কী কী ব্যবস্থা রয়েছে তাও আমরা দেখছি।’

সরকার কয়েক দিন কিছুটা নমনীয়তার নমুনা দেখালেও ২৯ জুলাইতে এসে তালগোল পেকেছে ক্ষমতাসীন দলের কর্মী ও পুলিশের ভূমিকায়। ২৯ জুলাই বিএনপির সমাবেশের আগের সপ্তাহগুলোতে কর্তৃপক্ষ দেড় হাজারেরও বেশি জনের নাম উল্লেখ করে বিরোধী নেতাকর্মী এবং অজ্ঞাত ১৫ সহস্রাধিক লোকের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। বিপুলসংখ্যক অজানা-অচেনা মানুষের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগের ব্যবহার বাংলাদেশে একটি সাধারণ অবমাননাকর অভ্যাস, যা পুলিশকে কার্যত কাউকে গ্রেফতারের ভয় দেখানো এবং হুমকি দেয়ার অনুমতি দেয়, বারবার গ্রেফতারের সুযোগ দেয়। অনেক ক্ষেত্রেই গ্রেফতারের অভিযোগ হয় ভিত্তিহীন। যাকে ‘ভূতের মামলা’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, তাতে অভিযুক্তদের কেউ কেউ হয় মৃত, বিদেশে, অথবা কথিত অপরাধের সময় হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে এ সংক্রান্ত তথ্য-সাবুদ পৌঁছে গেছে।

বর্তমানে চলমান স্নায়ুযুদ্ধের সময়, বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনের আগেই যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসঙ্ঘ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল নিরপেক্ষ, অবাধ, শান্তিপূর্ণ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের তাগিদের মধ্যে তালগোল পাকছে নানা দিকে। কেবল বাংলাদেশ নয়, স্নায়ুচাপে চলমান বিশ্বে আগের অনেক হিসাব বদলে গেছে। বাংলাদেশে গোলমালটা দৃশ্যত নির্বাচন নিয়ে। সঙ্গে মানবাধিকারসহ আরো কিছু। এর অনিবার্য জেরে দেশী-বিদেশী নানা পক্ষে বাংলাদেশকে ঘিরে চলমান রাজনীতি-কূটনীতি দেশকে কুরুক্ষেত্রে টেনে নিচ্ছে। সাদা চোখেই স্পষ্ট, যুদ্ধটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষের শক্তি আর বিপক্ষের শক্তির মধ্যে। রুশ-মার্কিন-ইউক্রেন-চীন-ভারত নানা ভুজে গুরুত্বপূর্ণ শরিক করে ফেলা হচ্ছে বাংলাদেশকে।

কূটনীতি মাড়িয়ে ক্ষেত্রবিশেষে অতি কূটনীতিতেও এগোতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের বাস্তবতাটা বেশি কঠিন। একাত্তরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের বিরুদ্ধে গিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ভারতের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কেবল সমর্থন নয়, সরাসরি সাহায্য করা একটি ইতিহাস। সময়ের ব্যবধানে শত্রু-মিত্র পাল্টে গেছে। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সঙ্গে চীন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আবার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টানাপড়েন চললেও সম্পর্ক খারাপ নয়। এ যেন যুক্তরাষ্ট্র-চীন-ভারতের সাথে সমান্তরালে সম্পর্কের ভারসাম্য রাখার চ্যালেঞ্জ।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
rintu108@gmail.com


Print Friendly, PDF & Email
 
 
জনতার আওয়াজ/আ আ
 

জনপ্রিয় সংবাদ

 

সর্বোচ্চ পঠিত সংবাদ