মুক্তির উদযাপনের খাঁচাও, নারীকে মুক্তি দেয় না – জনতার আওয়াজ
  • আজ দুপুর ২:২৫, বৃহস্পতিবার, ২৩শে মার্চ, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ৯ই চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ, ১লা রমজান, ১৪৪৪ হিজরি
  • jonotarawaz24@gmail.com
  • ঢাকা, বাংলাদেশ

মুক্তির উদযাপনের খাঁচাও, নারীকে মুক্তি দেয় না

নিজস্ব প্রতিবেদক, জনতার আওয়াজ ডটকম
প্রকাশের তারিখ: বুধবার, মার্চ ৮, ২০২৩ ২:৪০ অপরাহ্ণ পরিবর্তনের তারিখ: বুধবার, মার্চ ৮, ২০২৩ ২:৪০ অপরাহ্ণ

 

বেবী সাউ

ভারতের ঝাড়গ্রামের কবি, গল্পকার ও গবেষক। রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের পিএইচডি গবেষক

বিশ্বায়নের ফলে পৃথিবীতে অনেক কিছু পাল্টে গেছে। সমাজ এবং রাষ্ট্রে পরিবর্তন চোখে পড়ার মতো। তাছাড়া মানুষের মানসিকতার বেশ পরিবর্তন ঘটেছে এই দুই বছরে। কিন্তু নারীদের যে চিন্তাধারা এবং অবস্থান তার কতটা পরিবর্তন হয়েছে সেটা এখনও আলোচনার বিষয়। লকডাউনে আমরা দেখেছি, মেয়েদের ওপর বিশেষ করে সংসারী মেয়েদের এক হাতে অফিসের ল্যাপটপ অন্যহাতে রান্নার খুন্তি। কিন্তু সমীক্ষা বলছে অন্য কিছু, লেবার ফোর্স পার্টিসিপেশন রেট বা শ্রমশক্তিতে যোগদানের হিসেব। সারাবিশ্বের কর্মক্ষম বয়ঃসীমার মানুষের কত শতাংশ কাজ করতে আগ্রহী তার ওপর নির্ভর করে এই হার। লকডাউন, অতিমারি ইত্যাদির ফলে এই হার ক্রমশ হ্রাসের দিকে ছিল। পরবর্তী সময়ে সেটা অনেকটা বাড়লেও মহিলাদের মধ্যে সমীক্ষায় দেখা গেছে, কাজে যোগদান করার ক্ষেত্রে তা খুবই উদ্বেগজনক অবস্থায়। একটি সমীক্ষায় পাওয়া যাচ্ছে, শহর এবং গ্রামাঞ্চলের মহিলাদের শ্রমশক্তিতে যোগদানের প্রায় ২৮%। কিন্তু সেটা পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রায় ৭৫। এই বিপুল ব্যবধানের কারণই হচ্ছে মহিলা শ্রমিকদের মজুরির হার কম, সংসারের, সন্তানের দায়িত্ব ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এই হার ৫০ শতাংশের বেশি। চীনে এই হার ৭০ শতাংশ। বাংলাদেশে এই হারটির সূচক খুবই অগ্রসর হচ্ছে। আবার ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় ১৯৭০-৮০ দশকে পূর্ব এশিয়ার অগ্রগতির কারণই ছিল মেয়েদের শ্রমশক্তিতে যোগদান।

নারীদের শ্রমশক্তি বিষয়ক লেখাটি লিখতে বসে বিখ্যাত নারীবাদী লেখিকা মায়া এঞ্জেলোর শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি-সংবলিত গ্রন্থের শিরোনামটি মনে এলো। ‘খাঁচার পাখিটি কেন গান গায়, আমি তা জানি’। মনে এলো তাঁর জীবনের অসংখ্য মর্মস্পর্শী দুর্বিষহ স্মৃতি, যা একদিকে আমাদের প্রেরণা জোগায়, অন্যদিকে ব্যথায় ব্যথায় মন ভরে যায়। অফুরন্ত প্রেরণার উৎস এই নারী জন্মগ্রহণ করেন আমেরিকার একটি বর্ণবাদী সমাজে। একাধারে নারী, কৃষ্ণাঙ্গ, শ্রমজীবী, শৈশবেই ধর্ষণের শিকার এবং তারপর যৌনকর্মী। এ থেকে বোঝা যায়, নারী নিগ্রহের জ্বলন্ত উপমা হয়ে, পর্বতপ্রমাণ প্রতিকূলতা অতিক্রম করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বিশ্বের সেরা সাহিত্যিকদের একজন হিসেবে।

আরও কয়েকজন ইতিহাস সৃষ্টিকারী নারীর জীবনের গল্প উঠে আসে এ প্রসঙ্গে। দু দু’বার নোবেলজয়ী মারি কুরির জন্ম, বেড়ে ওঠা ও সীমাহীন প্রতিকূলতায় পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার গল্প। এখানেও একজন নারী সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হয়েছেন। এবং সমাজের বুকে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখেছেন।

আবার শ্রমজীবী পরিবারে জন্ম টনি মরিসনও নিজের জীবনের ও সমাজের ভয়াবহ অবস্থাটিকে তাঁর লেখায় নিয়ে এসেছেন, কৃষ্ণাঙ্গ নারী হয়ে প্রথম নোবেল পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছেন। এসব কথা শুধু প্রসঙ্গ ক্রমেই এসে পড়ে। কেননা, পথ এত সোজা নয়। প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এগিয়ে যাওয়াটাই প্রকৃত এক যোদ্ধাকে চিনতে সাহায্য করে।

মায়া এঞ্জেলোর মতে, শুধু পুরুষতান্ত্রিকতার কারণেই অবহেলিত বা নির্যাতিত হচ্ছে তা অনেকটা সত্য হলেও পুরোপুরি না। বরং নিজেরা নিজেদের এই অবস্থানের জন্য অনেকাংশে দায়ী। বিজ্ঞাপিত এই পৃথিবীর দিকে তাকালে প্রতি মুহূর্তে দেখতে পাই নারীকে গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করার নমুনা। এ ক্ষেত্রে পুঁজিবাদ, ঔপনিবেশিক মনোভাব, বর্ণবাদ বৈষম্য ও ব্যক্তিস্বার্থবাদ কাজ করছে বিপুলভাবে। আর এ ক্ষেত্রে নারীর সচেতন মনোভাবই একমাত্র পথ দেখাতে পারে।

কিন্তু এই সচেতন মনোভাবের প্রসঙ্গটি শুধু আওড়ানো বুলিতেই পর্যবসিত হয়েছে। সারাবিশ্বের কথা না হয় বাদ দিয়ে যদি ভারতীয় ঔপনিবেশিক সভ্যতায় দিকে তাকাই দেখব, এখানে নারীদের অবস্থান করুণ। শ্রমশক্তিতে তারা উপেক্ষিত। একজন পুরুষ কর্মী বা মজুরের যা মজুরি একজন নারী তা থেকে ৩০% থেকে ৪০% মজুরি কম পায়। কেন? সমাজের নিয়ম অনুযায়ী নারী কোমল, দুর্বল, পুরুষের তুলনায় অকর্মঠ। আর এইসব কারণে একজন পুরুষ কর্মীর চেয়ে একজন নারীর মজুরি কম। আর একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, লেবার ফোর্স পার্টিসিপেশন রেট বা শ্রমশক্তিতে যোগদানের হিসাব। সারাবিশ্বের কর্মক্ষম বয়ঃসীমার মানুষের কত শতাংশ কাজ করতে আগ্রহী তার ওপর নির্ভর করে এই হার। লকডাউন, অতিমারি ইত্যাদির ফলে এই হার ক্রমশ হ্রাসের দিকে ছিল। পরবর্তীকালে সেটা অনেকটা বাড়লেও মহিলাদের মধ্যে সমীক্ষায় দেখা গেছে, কাজে যোগদান খুবই উদ্বেগজনক অবস্থায়। ভারতের একটি সমীক্ষায় পাওয়া যাচ্ছে, শহর এবং গ্রামাঞ্চলের মহিলাদের শ্রমশক্তিতে যোগদানের প্রায় ২৮%। কিন্তু সেটা পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রায় ৭৫%। এই বিপুল ব্যবধানের কারণই হচ্ছে মহিলা শ্রমিকদের মজুরির হার কম, সংসারের, সন্তানের দায়িত্ব ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এই হার ৫০ শতাংশের বেশি। চীনে এই হার ৭০ শতাংশ। বাংলাদেশে এই হারটির সূচক খুবই অগ্রসর হচ্ছে। ১৯৭০-৮০ দশকে পূর্ব এশিয়ার অগ্রগতির কারণই ছিল মেয়েদের শ্রমশক্তিতে যোগদান।

এবার আসি, নারীদের মনস্তাত্ত্বিক দিকটি নিয়ে। আশাপূর্ণা দেবীর ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’ উপন্যাসে আমরা নারীর যে অবস্থানটি দেখে এসেছি আজ এতদিন পরও আর যে বিরাট কিছু পরিবর্তন হয়েছে তা নয়। দেখি নারী-মনের কী বিপুল টানাপোড়েন। এক নারী মুক্তি চাইছে অন্য নারী নিজেকে জড়িয়ে দিচ্ছে এবং অন্যকেও টেনে আনতে চাইছে বস্তাপচা কিছু নিয়মের দোহাই দিয়ে। এ ক্ষেত্রে আমরা প্রায়শই দেখি, সমাজের দায়বদ্ধতা দিয়ে, নিয়মকানুন দিয়ে নারীই নারীর কেমন শত্রু হয়ে ওঠে! কীভাবে নির্যাতন, অত্যাচার সহ্য করতে করতে শিখে নেয়, মেনে নেয় সমাজের নির্যাতনকে আর তাকেই ভাগ্য বলে বিশ্বাস করে। একটা কথা স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা যায় এবং জোর দিয়ে বলা যায়, নারী যদি নিজে নিজের স্বাধীনতা না চায়, পৃথিবীর কোনো সমাজ, সংগঠন কেউই স্বাধীনতা দিতে পারবে না। মুক্ত করতে পারবেও না এই সমাজের কুসংস্কারময় বন্ধন থেকে। আর এই অবস্থানের জন্য নারীবাদী সমাজ গঠন, তকমা, পোস্টার কিংবা একটা দিন ধার্য করে কিছু হবে না। নারীকেই হয়ে উঠতে হবে একে অপরের দোসর। নিজের আয়নায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে চিনে নিতে হবে নিজের আশা, আকাঙ্ক্ষা, চাহিদা এবং ইচ্ছেগুলোকে। নারীর মধ্যে এই সচেতনতা নিজেকেই তৈরি করতে হবে। অন্যের হাত ধরে নয়, নারীর প্রয়োজন নিজের পা দুটিকে চিনে নেওয়া। বড় জরুরি নিজস্ব শক্তি এবং সাহসের।

তবে সুখের কথা এই যে, পুরোটাই অন্ধকারে ঢাকা নয়। আলোও রয়েছে। বহু নারীই অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছেন কোনোভাবেই তাঁদের দমানো যাবে না। এই মেট্রোসিটি এবং বহু জেলা-শহরে টোটোচালক হিসেবে নারীদের কাজ করতে দেখা যাচ্ছে। হোটেল অথবা চায়ের দোকান চালাতেও নারীরা পিছপা হননি, এমনকি সবাইকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ডেলিভারি-গার্ল হিসেবেও কাজে যোগ দিচ্ছেন। সংখ্যায় হয়তো এঁরা বিরাট আকারের নন, তবে শুরুটা এভাবেই হচ্ছে এটা আশার কথা তো বটেই। নারীকে নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে দেওয়া হয়নি, খুব ধীরে হলেও সেই জায়গা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টাটা তৈরি হচ্ছে। হয়তো কাজটা সহজ নয়, বাধা-বিপত্তি আসবে আরও নানাদিক থেকেই; তবু যুগ বদলাচ্ছে, আগেকার মতো তথ্যের অভাব এখন নেই, নেই সুযোগের অভাবে গুমরে মরা। সমাজ কখনও রাতারাতি বদলায় না। নিজে না এগিয়ে এলে সমাজের নীতি সেই একই পথে চলতে থাকবে, এর নড়চড় হবে না। নারীকে অবলা, কোমলমতি, ‘মায়ের জাত’ বলে দুর্বল করার প্রক্রিয়া এখন আগের মতো কাজে দেয় না। নারী শরীরের অধিকার বুঝে নিতে চাইছে, চাইছে নিজের পরিচয় তৈরি করতে। এমনকি সন্তান পালনেও নারী বেছে নিচ্ছে ‘সিঙ্গল মাদার’ হওয়ার স্বপ্ন। তাছাড়া বর্তমানযুগে যা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, এক সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থা। এই সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থার জন্য চাই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সাম্যবাদী দল গঠন। এখানে ‘আমি নারী’ কিংবা ‘আমি পুরুষ’ না ভেবে যদি ‘আমি মানুষ এবং আমারও কিছু দাবি দাওয়া চাওয়া-পাওয়া আছে’ ভাবতে শিখি তবেই বোধহয় সমাজে অবস্থান পাল্টাবে। না হলে ‘বামন হয়ে চাঁদে হাত’ বাড়াব কি বাড়াব না ভাবতে ভাবতেই আরও শত বছর কেটে যাবে। কালেকটিভ স্পিরিট অর্থাৎ মূল চেতনাটাই হলো সাম্যচেতনা। পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে এই চেতনা জেগে উঠলেই এই স্বাধীন চিন্তার প্রকাশ ঘটলেই প্রতিটি দিনই হয়ে উঠবে ৮ই মার্চ। আর তখন পৃথিবী কয়েক আলোকবর্ষ এগিয়ে যাবে, সন্দেহ নেই। নারী নিজেই শিখবে খাঁচার অসারতা। বাঁচার মন্ত্র। কারণ মুক্তি দেবে কে? নারীকে নিজেই নিজের মুক্তির ঠিকানা খুঁজে নিতে হবে।

বেবী সাউ: কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক; রাঁচি ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক

Print Friendly, PDF & Email
 
 
জনতার আওয়াজ/আ আ
 

জনপ্রিয় সংবাদ

 

সর্বোচ্চ পঠিত সংবাদ

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com