রাজনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন না আনলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না : আবুল কাসেম ফজলুল হক
নিজস্ব প্রতিবেদক, জনতার আওয়াজ ডটকম
প্রকাশের তারিখ:
রবিবার, জুলাই ২৮, ২০২৪ ৩:৩৩ অপরাহ্ণ পরিবর্তনের তারিখ:
রবিবার, জুলাই ২৮, ২০২৪ ৩:৩৩ অপরাহ্ণ

জনতার আওয়াজ ডেস্ক
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে দেশে ব্যাপক সহিংসতা, প্রাণহানি ও নাশকতার ঘটনা ঘটেছে। এখন চলছে ধরপাকড় ও গ্রেপ্তার। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশে একটি সংকট তৈরি হয়েছে। ফলে সরকারকে কারফিউ জারি করতে হয়েছে। ধ্বংসযজ্ঞ ও নাশকতায় বিএনপি-জামায়াতের সংশ্লিষ্টতার কথা বলেছে সরকার। আর বিরোধী মহল বলছে, আন্দোলন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত
রাষ্ট্রচিন্তক ও বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেছেন, শুধু কোটার ইস্যুতে আন্দোলন শুরু হলেও পরে সেটি একটিমাত্র বিষয়ে সীমাবদ্ধ থাকেনি। দীর্ঘদিন ধরে নানা কারণে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ জমেছিল। সেটির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। ছাত্রদের ক্ষোভের বিষয়টি আগেই উপলব্ধি করে সরকারের উচিত ছিল ক্ষোভ প্রশমনের ব্যবস্থা করা। সেটি করা হয়নি বলেই ঘটনা এতদূর গড়িয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলো শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য রাজনীতি করে। জনগণের সমস্যা কেউ সমাধান করতে চায় না। তাই কোনো উন্নয়নশীল রাজনৈতিক ধারা গড়ে উঠছে না। গতানুগতিক ধারা বাদ দিয়ে রাজনীতিতে নতুন ও মৌলিক পরিবর্তন দরকার। সমকালকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন তিনি।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ব্যাপক সহিংসতা, প্রাণহানি ও নাশকতার ঘটনা ঘটেছে। আপনার মূল্যায়ন কী?
আবুল কাসেম ফজলুল হক : একটা ব্যাপার সত্যি, শুধু কোটার ইস্যুতে আন্দোলন শুরু হলেও পরে সেটিতে সীমাবদ্ধ থাকেনি। দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ দ্রব্যমূল্য, অনেকটা একদলীয় কায়দায় জাতীয় নির্বাচন হওয়াসহ নানা কারণে মানুষের মাঝে ক্ষোভ জমে ছিল। অনেকে ভোট দিতে পারেননি, এটিকে কোনো বিচারেই ভালো নির্বাচন বলা যায় না। বেশির ভাগ সরকারি নিয়োগ এখন পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে হয়। এই নিয়োগে একসময় ৫৬ শতাংশ কোটা ছিল। এর বড় অংশ ৩০ শতাংশ ছিল মুক্তিযোদ্ধা কোটা। আমরা দীর্ঘদিন থেকে বলে আসছিলাম, এই কোটা একেবারেই অযৌক্তিক। মুক্তিযোদ্ধারা নিজেরা এই সুবিধা পেলে কারও আপত্তি নেই। সন্তানদের ক্ষেত্রেও তা মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু একসময় দেখা গেল, মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিপুতি তথা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এটা চালানোর চেষ্টা চলছে। এটা বৈষম্য হিসেবেই তরুণরা বিবেচনা করেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও কিছু বিষয়। একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান যখন এই কোটার পক্ষে কথা বললেন, ‘রাজাকারের নাতিপুতিদের চাকরি দেব নাকি’ বললেন, তখন ছাত্রসমাজ ক্ষোভে ফেটে পড়ল। তারা পথে নেমে এলো।
আন্দোলনকারী ছাত্রদের কিন্তু রাজাকার বলা হয়নি…
আবুল কাসেম ফজলুল হক : কিন্তু ছাত্ররা এতে ক্ষুব্ধ হয়েছে। আমার পরিষ্কার মনে আছে– বঙ্গবন্ধু সরকারের শেষ দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতি পরিচিত এক লেখক, যিনি মুক্তিযোদ্ধা, একটি বই লেখেন, শিরোনাম ‘আমি রাজাকার বলছি’। তিনি রাজাকার ছিলেন না, ছিলেন প্রগতিশীল লেখক ও স্থানীয় কলেজের অধ্যক্ষ। তিনি যখন এই শিরোনামে বই লেখেন, তখন বুঝতে হবে কোনো ক্ষোভ থেকে সেটি লিখেছেন। ঠিক একইভাবে ছাত্ররা যদি এখন স্লোগান দেয়– ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’ তাহলে বুঝতে হবে তাদের মাঝে ক্ষোভ রয়েছে। ছাত্রদের ক্ষোভের বিষয়টি তখনই উপলব্ধি করে সরকারের উচিত ছিল প্রশমনের ব্যবস্থা করা। সেটি করা হয়নি বলেই ঘটনা এতদূর গড়িয়েছে।
আর ছাত্রদের রাজাকার বলা হয়নি বলা হলেও আওয়ামী লীগের নেতা ও সরকারের একাধিক মন্ত্রীর সে সময়ের বক্তব্য গণমাধ্যমে দেখুন, তারা সরাসরি না বললেও ছাত্রদের এটিই বোঝাতে চেয়েছেন।
আন্দোলন কেন সহিংসতায় রূপ নিল?
আবুল কাসেম ফজলুল হক : সরকার শুরুতে ছাত্রদের আন্দোলনকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ আন্দোলনকে সহিংসতার দিকে মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। তারা প্রথমে বাংলা ব্লকেড, পরে কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি দিয়েছে। দেশজুড়ে জ্বালাও-পোড়াও শুরু হয়েছে। এই জ্বালাও-পোড়াও দেখে বোঝা যায়, এতে অশুভ শক্তির পরিকল্পনা আছে। সরকারের দায়িত্ব ছিল, এসব পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দেওয়া। সরকার বলছে, এর পেছনে জামায়াত-বিএনপি আছে। কিন্তু যা বলছে না তা হলো, এই চক্রান্তের পেছনে দেশের ভেতরের পাশাপাশি বাইরের চক্রান্তও রয়েছে। বাইরের চক্রান্তকারীদের ব্যাপারেও জনগণকে সজাগ থাকতে হবে।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ কী বলে মনে করেন?
আবুল কাসেম ফজলুল হক : সাময়িক চলনসই একটা পরিস্থিতি তৈরির জন্য সরকার চেষ্টা করছে। তবে এতে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হবে বলে মনে করি না। কারণ, বর্তমান পরিস্থিতি থেকে সরকার রাজনৈতিক সুবিধা নিতে চাইছে। বিরোধী মত দমনপীড়ন করার পন্থা নেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে আগামী নির্বাচনের পথ পরিষ্কার করছে। সরকারকে বুঝতে হবে, আগামী নির্বাচন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি আর বিপক্ষের শক্তি– এই বিভাজনে হবে না, কোটা আন্দোলন তার প্রমাণ। সরকারের আরেকটি বড় ভুল, কোটা আন্দোলনে ছাত্রলীগকে ব্যবহার করা। ছাত্রলীগে এখন ছাত্রদের নিয়ে রাজনীতি কতটুকু আছে? নানা দুষ্কর্মে তারা জড়িত। সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে তাদের গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু?
উত্তরণের পথ হলো, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে মানুষের চাওয়া অনুসারে দেশ পরিচালনা করা। বৈষম্য কমানো, সর্বত্র সাম্য তৈরি করা। পুলিশ, সেনা, বিজিবি ও র্যাব নামিয়ে তো দীর্ঘকাল দেশ শাসন করা যাবে না। জনগণের সমস্যা সমাধানে তৎপর হলেই জনগণ সরকারকে সময় দেবে। আর দরকার রাজনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন।
সেটা কীভাবে?
আবুল কাসেম ফজলুল হক : আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলো শুধু ক্ষমতায় যেতে চায়। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য রাজনীতি করে। জনগণের সমস্যা কেউ সমাধান করতে চায় না। ক্ষমতায় যেতে আওয়ামী লীগ কিছু দলের সঙ্গে সখ্য গড়েছে, বিএনপিও তাই করেছে। জনগণের চাওয়া অনুসারে প্রকৃত রাজনৈতিক কর্মসূচি কারও নেই। বাংলাদেশে তাই কোনো উন্নয়নশীল রাজনৈতিক ধারা গড়ে উঠছে না। সে জন্য বলছি, গতানুগতিক ধারা বাদ দিয়ে রাজনীতিতে নতুন ও মৌলিক পরিবর্তন দরকার।
আপনাকে ধন্যবাদ।
আবুল কাসেম ফজলুল হক : আপনাকেও ধন্যবাদ।
সূত্রঃ সমকাল
জনতার আওয়াজ/আ আ
