রাজার দল নাকি দলের রাজা : মারুফ কামাল খান - জনতার আওয়াজ
  • আজ রাত ৯:৩৪, শনিবার, ২২শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৮ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২২শে রমজান, ১৪৪৬ হিজরি
  • jonotarawaz24@gmail.com
  • ঢাকা, বাংলাদেশ

রাজার দল নাকি দলের রাজা : মারুফ কামাল খান

নিজস্ব প্রতিবেদক, জনতার আওয়াজ ডটকম
প্রকাশের তারিখ: শুক্রবার, মার্চ ৭, ২০২৫ ৪:৪৬ অপরাহ্ণ পরিবর্তনের তারিখ: শুক্রবার, মার্চ ৭, ২০২৫ ৪:৪৬ অপরাহ্ণ

 

বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা তাদের নতুন রাজনৈতিক দল বানিয়েছেন। এ দলের নাম জাতীয় নাগরিক পার্টি। ইংরেজিতে ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি; সংক্ষেপে ‘এনসিপি’। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে জাতীয় নাগরিক কমিটি নামের রাজনৈতিক প্ল্যাটফরম গঠন করে এই শিক্ষার্থীরা প্রস্তুতিপর্ব সম্পন্ন করেছেন। তারপর এলো এই পরিপূর্ণ রাজনৈতিক দল। নতুনের আগমনকে স্বাগত জানানোই রেওয়াজ। সেই রীতি মোতাবেক ছাত্রছাত্রীদের গড়া এই দলের অভ্যুদয় উপলক্ষে শুভকামনা জানাচ্ছি। আহলান ওয়া সাহলান এনসিপি।

এই শিক্ষার্থী কারা? দেড় দশকজুড়ে হাসিনার যে ফ্যাসিস্ট রেজিম চলেছে, সেই দুঃশাসন যাদের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সূচিত জনগণের অভ্যুত্থানে উৎখাত হয়েছেন, এরা হচ্ছেন সেই শিক্ষার্থীদের দল। এই সাধারণ শিক্ষার্থীরাই এক অসাধারণ ঘটনা ঘটিয়ে বিশিষ্টতা অর্জন করেছেন। রুশ বিপ্লবের তত্ত্বগুরু ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের একটি বিখ্যাত উক্তি : ‘There are decades where nothing happens; and there are weeks where decades happen.’ এর বাংলা তরজমা : ‘অনেক নিষ্ফলা দশক পেরিয়ে যায়, যখন কিছুই ঘটে না। আবার এমন কিছু সপ্তাহ আসে, যখন অনেক দশকের ঘটনা ঘটে যায়।’ বাংলাদেশের এই সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্যই যেন লেনিন তার ওই কালোত্তীর্ণ উক্তিটি করেছিলেন। বিপুল রক্তঝরা আন্দোলনে পনেরো বছরে হাসিনার ফ্যাসিস্ট রেজিমের কিছুই করা সম্ভব হয়নি। অথচ এই ছাত্রদের মাত্র কয়েক সপ্তাহের আন্দোলন এমন দুর্নিবার অভ্যুত্থান রচনা করল, যাতে দুঃশাসনের তখতে তাউস উড়ে গেল তাসেরঘরের মতো। শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে সংঘটিত বাংলাদেশের এই অভ্যুত্থান বিশ্বের এক অপার বিস্ময়। পশ্চিমি দুনিয়া এর নাম দিয়েছে ‘মনসুন রেভ্যুলেশন’। এ নিয়ে তাদের গবেষণার অন্ত নেই। ছাত্রনেতারা তাদের সফল ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানকে এখন রাষ্ট্রের বৈপ্লবিক রূপান্তরের দিকে পরিচালিত করতে চান। সেই লক্ষ্য অর্জনের বাহন হিসেবেই এই নয়া পার্টি তারা গঠন করেছেন। জিয়াউর রহমান ও শেখ মুজিবুর রহমানের পারিবারিক উত্তরাধিকারীদের নেতৃত্বের বলয়ের বাইরে গঠিত নতুন এই দল পরিবারতন্ত্র ও পার্সোনালিটি কাল্ট বা ব্যক্তিত্ব অর্চনার বাইরে যৌথ নেতৃত্বের আদলে গণতান্ত্রিক রীতিতে পরিচালিত হওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে বলেছে, তারা এ দেশে কৃষকের সন্তানের সরকারপ্রধান হওয়ার সুযোগ ও পরিবেশ অবারিত করবে।

ষাটের দশকে এস্তোনীয় ইহুদি বংশোদ্ভূত আমেরিকান স্থপতি লুই ইসাডোর কানের স্থাপত্য নকশায় পাকিস্তানে ফিল্ডমার্শাল আইউব খানের বুনিয়াদি গণতন্ত্রের জামানায় ঢাকায় যে বিশ্ববিশ্রুত ইমারত তৈরি শুরু হয়েছিল, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ভবন হিসেবে সেটির নির্মাণকাজ সমাপ্ত করান। তার উত্তরসূরি জাস্টিস আব্দুস সাত্তার সেই ভবনে জাতীয় সংসদের অধিবেশন চালু করেন। ওই অট্টালিকাই এখন বাংলাদেশে গণতন্ত্রের মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছে। সেই ভবনের সামনে মানিক মিয়া এভিনিউয়ের প্রশস্ত চত্বরে মস্ত বড় এক লোকসমাবেশের মঞ্চ থেকে এই নতুন দলের অভ্যুদয় ঘোষিত হয়েছে গত ফেব্রুয়ারির আঠাশ তারিখ অপরাহ্ণে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে এত সাড়ম্বরে আর কোনো রাজনৈতিক দলের উদ্বোধন অনুষ্ঠান হয়নি।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মন্ত্রী-ক্ষমতার উপদেষ্টা পদে ইস্তফা দিয়ে ছাত্র আন্দোলনের নেতা নাহিদ ইসলাম এই নয়া দলের শীর্ষপদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। তবে তার সঙ্গে একই আন্দোলনে ভূমিকা পালনকারী দুজন এখনো উপদেষ্টা পদে বহাল আছেন। বর্তমান সরকারপ্রধান, দেশের একমাত্র নোবেল লরিয়েট ড. মুহাম্মদ ইউনূস ছাত্রদের গড়া দলের নেতৃত্ব গ্রহণের প্রস্তাবে রাজি না হলেও তিনি এই দল গড়ায় উৎসাহ জুগিয়েছেন বলে নিজ মুখে স্বীকার করেছেন। তা ছাড়া দলটির উদ্বোধন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে জেলা শহর থেকে ঢাকায় আসা-যাওয়ার সুবিধার্থে অন্তত একটি জেলার প্রশাসন যানবাহনের ব্যবস্থা করে দেওয়ার প্রমাণ মিলেছে। এসব কারণে সমালোচকরা এই নয়া দলকে ‘কিংস পার্টি’ বা রাজার দল বলে চিত্রিত করছেন।

বাংলাদেশে কিংস পার্টি বা রাষ্ট্রক্ষমতার আশীর্বাদে গঠিত দলের ইতিহাসে শেখ মুজিবুর রহমানের বাকশাল, জিয়াউর রহমানের বিএনপি, এইচ এম এরশাদের জাতীয় পার্টি এবং ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিনের এক-এগারো জামানায় এবং হাসিনার আমলে সেনা গোয়েন্দাদের মদতে গঠিত দলগুলোর কথা আলোচিত হয়। এর মধ্যে বিএনপি ছাড়া আর কোনো দলের ভাগ্য তেমন সুপ্রসন্ন হয়নি। মুজিব সরকার উৎখাতের সঙ্গে বাকশাল বিলুপ্ত হয়েছে। এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর জাতীয় পার্টিকে ক্ষমতাসীনদের করুণানির্ভর হয়ে অস্তিত্ব রক্ষা করতে হয়েছে। আর এক-এগারো ও হাসিনার আমলে গড়া কিংস পার্টিগুলোর প্রায় সবই কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছে। শুধু বিএনপিই সুদিন-দুর্দিনের সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে জনসমর্থনধন্য অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রবল প্রতাপে বিরাজ করছে। খুব নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করলে বিএনপিকে অন্য দলগুলোর মতো ঢালাওভাবে কিংস পার্টি বলার সুযোগও কম। শেখ মুজিব সব দল নিষিদ্ধ করে একমাত্র কিংস পার্টি বাকশাল গঠন করেছিলেন। তার শাসনকালের রক্তক্ষয়ী অবসানের পর খন্দকার মোশতাক আহমদ বাকশালও বিলুপ্ত করে দেন। জিয়াউর রহমান যখন রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেন, তখন দেশে একটি রাজনৈতিক দলেরও অস্তিত্ব ছিল না। তিনি পলিটিক্যাল পার্টি রেগুলেশন বা পিপিআরের আওতায় প্রতিটি রাজনৈতিক দল গঠনের ব্যবস্থা করেন। সেই ব্যবস্থাপনায় অন্যান্য দলের সঙ্গে বিএনপিও গঠিত হয়। শূন্য থেকে নতুন করে দল গঠনের এই প্রক্রিয়ায় বিএনপিকে কিংস পার্টি বলা হলে ওই সময়ে গঠিত বাংলাদেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দলকেই কিংস পার্টি বলতে হয়। তা ছাড়া ইতিহাসের নানা অভিঘাত পেরিয়ে এসে এক দীর্ঘ সময়ে বিএনপি কিংস পার্টি বা রাজার দলের বদনাম ঘুচিয়ে দলের রাজা বা সেরা দল হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে। বিএনপির মতো নবগঠিত এনসিপি রাজার দলের অভিধা মুছে দলের রাজা হয়ে উঠতে পারবে কি না, সেটা ভাবীকালই নির্ধারণ করবে।

তারুণ্যখচিত দল এনসিপির অভ্যুদয় মনে করিয়ে দেয় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলÑজাসদের কথা। স্বাধীনতার পরপরই আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ছাত্র-তরুণরা গড়েছিলেন জাসদ। বিরাট সম্ভাবনা নিয়ে আলোড়ন তোলা জাসদ ছিল নবগঠিত বাংলাদেশে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েমের অঙ্গীকারে দীপ্ত। ১৯৭২ সালের অক্টোবরে গঠিত জাসদকে মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে দেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়েছিল। সে নির্বাচন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডে হতে দেওয়া হয়নি। ব্যালটের লড়াইয়ে জাসদের সক্ষমতাকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অস্ত্রের ভাষায় মোকাবিলা করে। ওই নির্বাচনের তিক্ত অভিজ্ঞতা জাসদকে ঠেলে দেয় সশস্ত্র প্রতিরোধের পথে। এতে খুব দ্রুতই জাসদ গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে অপাঙ্‌ক্তেয় হয়ে পড়ে। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথ হারিয়ে জাসদ সন্ত্রাসের চোরাবালিতে আটকা পড়ে। জাসদের ইতিহাস হয়ে দাঁড়ায় বিভ্রান্ত তারুণ্যের দিগভ্রান্ত অভিযান। সেই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে এনসিপি কতটা সন্তর্পণে পথ চলতে পারবে, তার ওপর তাদের সাফল্য ও ব্যর্থতা অনেকটাই নির্ভর করবে। এনসিপির পক্ষ থেকে অবশ্য বলা হয়েছে, এ দেশে ছাত্র-তরুণরা ঘাতকের বুলেট বুক পেতে নিয়ে ফ্যাসিবাদের পতন ঘটিয়েছে। এখন তারা ব্যালট মোকাবিলায় প্রস্তুত। আর নয় রক্তপাত, গণতান্ত্রিক পন্থাতেই হবে তাদের এখনকার অগ্রযাত্রা।

রাস্তা আটকে সমাবেশ করে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি এবং মঞ্চে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান লাভের জন্য ঠেলাঠেলির গতানুগতিক বাজে নজির থেকে নতুন দলের উদ্বোধন অনুষ্ঠান মুক্ত হতে পারেনি। তবে মঞ্চে আসন-বৈষম্যের বদলে সবাই জানু পেতে একই সমতলে বসে এবং শহীদ পরিবারের সদস্যকে দিয়ে প্রস্তাব উপস্থাপন করিয়ে কিছুটা নতুনত্বের পরিচয় দিয়েছে। আয়-ব্যয়ের ব্যাপারে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো খুবই প্রশ্নবিদ্ধ। এই পরিস্থিতিতে এনসিপির জমকালো উদ্বোধন অনুষ্ঠানের ব্যয় এবং তহবিল সংগ্রহ নিয়ে নানা মহল থেকে প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। এর জবাবে নতুন দলের নেতারা জানিয়েছেন, তারা দলের আয় ও ব্যয়সংক্রান্ত প্রতিটি পয়সার হিসাবের ব্যাপারে স্বচ্ছ থাকতে চান। অচিরেই তারা তাদের সমুদয় হিসাব দলের ওয়েবসাইটে কিংবা সংবাদ সম্মেলন মারফত জনসমক্ষে প্রকাশ করবেন। ফ্যাসিবাদের দালাল পুঁজিপতি ও অলিগার্কদের কাছ থেকে তারা কোনো অর্থ নেবেন না কিংবা দলের আদর্শকে প্রভাবিত করতে পারে, এমন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদা এবং অনুদান না নেওয়ার অঙ্গীকারও তারা ব্যক্ত করেছেন। এনসিপিতে নারী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উল্লেখযোগ্য প্রতিনিধিত্ব থাকলেও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি ছিল বিরল। অহেতুক উচ্চকণ্ঠে চিৎকার করে বক্তৃতা করাটাও বেশ দৃষ্টিকটু মনে হয়েছে। ডান, বাম ও চরমপন্থাকে পাশ কাটিয়ে নতুন দল মধ্যপন্থা অবলম্বনের কথা ঘোষণা করেছে। গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের নীতিমালার ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনর্গঠনের প্রত্যয়ে এনসিপি সেকেন্ড রিপাবলিক গঠনকে তাদের ঘোষিত রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। এই লক্ষ্যে বাহাত্তরের মুজিববাদী সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান রচনা তাদের অঙ্গীকার। নয়া সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে গণপরিষদ নির্বাচন চান তারা। এ নির্বাচন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে একত্রে সেরে ফেলার প্রস্তাব তারা দিয়েছেন। এ ছাড়া নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার সক্ষমতার ট্রায়াল হিসেবে তারা জাতীয় সংসদের আগে স্থানীয় নির্বাচনের পক্ষে যুক্তি দিচ্ছেন। হাসিনাসহ পতিত ফ্যাসিবাদীদের বিচারের আগে সংসদ নির্বাচন করলে সংস্কার বাধাগ্রস্ত হবে এবং ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থানের আশঙ্কা দেখা দেবে বলেও তারা মনে করছেন। তাদের এ অবস্থান বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের অবস্থানের বিপরীত। এই মতভেদের কীভাবে নিরসন ঘটবে অথবা এ থেকে নতুন করে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সৃষ্টি হবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।

নবগঠিত এনসিপির নেতারা বেশিরভাগই সংরক্ষিত কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়েই পাদপ্রদীপের আলোয় এসেছেন। এর আগে তাদের অনেকেই ছাত্রলীগ, ছাত্রশিবির ও ভিপি নুরের ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ছাত্রদল ও বামপন্থা থেকেও এসেছেন মুষ্টিমেয়সংখ্যক। যদিও অতীতের এসব অবস্থানকে অনেকেই কৌশলগত ও আত্মরক্ষামূলক বলে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু ফ্যাসিস্ট জামানায় বিভিন্ন সংগঠনে অনুপ্রবেশ যে অনর্থ ঘটিয়েছে ও বিতর্ক সৃষ্টি করেছে, তাতে এনসিপি নেতাদের অতীত অবস্থান সম্পর্কে সব সন্দেহ বিশ্বাসযোগ্যভাবে নিষ্পত্তি করতে হবে। ইন্ডিয়ান হেজিমনির প্রোপাগান্ডা মেশিনগুলো ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতি সমর্থন জানাতে এবং এনসিপিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী ও পাকিস্তানপন্থি ধারা হিসেবে প্রচার চালাতে শুরু করেছে। এনসিপি শক্তিশালী হওয়ার আলামত দেখা গেলে এই প্রোপাগান্ডা আরো জোরালো হবে। এই চ্যালেঞ্জ তাদের মোকাবিলা করতে হবে।

হাসিনা রেজিমে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মী এবং আলেম-ওলামারা সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। রেজিম পতনে তারাই সবচেয়ে বেশি উপকৃত ও লাভবান হয়েছেন। শেষ সময়ে এসে জামায়াত নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে সে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার না হলেও দলটি অবাধে স্বাভাবিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্র ও সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে জামায়াত তাদের নিজেদের লোকদের বসাতে পারছে। আলেমরাও নির্যাতন ও কারামুক্ত হয়ে ইতোমধ্যে যথাযোগ্য মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ বিএনপি নেতাকর্মীরা তাদের বিরুদ্ধে হাসিনার আমলের অন্যায় মামলাগুলোয় ন্যায়বিচার পাচ্ছেন। ছাত্ররা উচ্চ আদালত থেকে হাসিনা নিযুক্ত দলবাজ বিচারকদের আন্দোলন করে হঠিয়ে না দিলে ন্যায়বিচারের এই পরিবেশ সৃষ্টি হতো না। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানগুলোয় বিএনপি ইতোমধ্যেই নিজেদের লোক বসাতে পেরেছে। দলটি এখন অনেকটাই ক্ষমতাসীন দলের মতো ক্ষমতাচর্চার সুযোগ পাচ্ছে। এসব কারণে ছাত্রদের এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপি ও জামায়াতের সবচেয়ে বেশি সুসম্পর্ক থাকার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে জামায়াতের সঙ্গে সুসম্পর্ক কিছুটা বহাল থাকলেও বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কের মধ্যে প্রচুর বরফ জমে গেছে। সম্পর্কের এই টানাপড়েনের মাশুল দিনের শেষ কোনো না কোনো পক্ষকে দিতে হবে।

হাসিনা রেজিম উৎখাতের প্রশ্নে ডান, বামসহ প্রায় সব ঘরানার রাজনৈতিক দল ও সমাজশক্তিগুলোর অবস্থান ছিল অভিন্ন। কিন্তু ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর প্রত্যেকেই নিজ নিজ আদর্শ ও কর্মসূচিতে ফিরে গেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই আদর্শ ও কর্মসূচিগত দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। বিএনপি আগাগোড়াই একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটি সুষ্ঠু, অবাধ, গ্রহণযোগ্য ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করে এসেছে। হাসিনা সরকারের পতনের পর বিএনপির সেই দাবি পূরণের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় দলটির নেতাকর্মীদের অনেকেই খুশি। তারেক রহমান অবশ্য বারবার সতর্কতা অবলম্বনের ডাক দিয়ে যাচ্ছেন। বিএনপি নেতাদের বড় অংশ চান অবিলম্বে সংসদ নির্বাচন হোক, মানুষ ভোট দিয়ে এমপি বানাক, সেই এমপিরা একটা সরকার গড়ে দিক, ব্যস কেল্লাফতে। এর বাইরে তাদের আর তেমন কোনো চাওয়া-পাওয়ার নেই। অনেক দিন ধরে ছাত্র-তরুণরা রাষ্ট্র মেরামতের যে দাবি করে আসছিল, তাতে সাড়া দিয়ে বিএনপি ৩১ দফা কর্মসূচি পেশ করেছে। ভোটে জিতে তারা তার বাস্তবায়ন করবে। তারেক রহমানের সতর্কবাণী সত্ত্বেও বিএনপি নেতাদের অনেকে ধরেই নিয়েছেন, ভোট হলে তারাই জিতবেন, সেটাই হবে জনগণের সরকার এবং সেই সরকার ৩১ দফা বাস্তবায়ন করলেই সংস্কারের কাজ সারা হয়ে যাবে। জাতীয় ঐকমত্যভিত্তিক সংস্কারের কথায় তারা বিরক্ত হন। একটি সুষ্ঠু ভোট মানেই তাদের বিবেচনায় গণতন্ত্র এবং সেটাই জনগণের সরকার। এর বাইরে আর কারো কোনো অধিকার নেই। তার মানে তারা নির্বাচিত সরকারের ডিক্টেটরশিপের পুরোনো ব্যবস্থারই স্ট্যাটাস কৌ চান। সেই চাওয়া থেকেই এই নেতারা মুজিববাদী সংবিধান ও হাসিনার রাষ্ট্রপতিকে অক্ষুণ্ণ রেখেছেন এবং বিপ্লবের প্রোক্লেমেশনে আপত্তি তুলেছেন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে বিএনপির ওই নেতারা নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অতিরিক্ত কিছু ভাবতে পারছেন না। চটজলদি একটা ইলেকশন করে সরে যাওয়া ছাড়া এই সরকারের আর কিছু করতে যাওয়াকে তারা ধৃষ্টতার শামিল ও এখতিয়ারবহির্ভূত বলেই মনে করেন। গণঅভ্যুত্থানের ফসল অন্তর্বর্তী সরকার ও আন্দোলনজয়ী ছাত্রদের বিপ্লবী বৈধতা বিএনপির ওই নেতারা স্বীকার করতে চান না এবং নানাভাবে তারা প্রশ্ন তুলেই যাচ্ছেন, তোমরা কে হে?

জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে হাসিনা রেজিমের পতন না হলে সংসদ নির্বাচনের জন্য যে আরো সাড়ে ৪ বছর অপেক্ষা করতে হতো, সে বাস্তবতা ভুলে গিয়ে বিএনপির ওই নেতারা নির্বাচন বিলম্বিত করার অভিযোগ তুলছেন। তারা বুঝতে চাইছেন না যে, নির্বাচন একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতার ব্যাপার, একদলীয় কোনো বিষয় নয় এবং সব স্টেকহোল্ডারের মতামতের ভিত্তিতে এ-সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিএনপির এই নেতারা তাদের অবিলম্বে নির্বাচনের এজেন্ডা বাকি সবার ওপর চাপিয়ে দিতে চাইছেন। অতীতে অনেক সংগ্রামে অর্জিত সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সব সমস্যার নিরসন হয়নি এবং প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে স্বৈরাচার আবার ফিরে এসেছে। এই তিক্ত অভিজ্ঞতা বিএনপির ওই নেতারা আমলে নিতে চাইছেন না। নির্বাচন, সংস্কার ইত্যাদি বিষয়ে আন্দোলনকারী ছাত্রদের মতামতকেও বিএনপির ওই নেতারা গ্রাহ্য করতে চাননি। তাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ স্টেকহোল্ডার হিসেবে মানতেও চাননি। ফলে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, আন্দোলনকারী ছাত্রসমাজ ও অন্তর্বর্তী সরকারের চেয়ে পতিত ফ্যাসিবাদও আগামীতে তাদের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠার আশঙ্কা রয়ে গেছে। এই নেতাদের কেউ কেউ ইতোমধ্যে ফ্যাসিবাদের ফেলে যাওয়া জুতায় পা গলিয়েছেন। এ অবস্থার পরিবর্তন ছাড়া এত রক্তদানে অর্জিত বিজয় ব্যর্থ হয়ে যাবে।

ফ্যাসিস্ট হাসিনা রেজিমের পতনের পর থেকেই আমি ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিএনপি নেতা তারেক রহমানের মধ্যে একটি মিথস্ক্রিয়ার কথা বলে আসছি। বিএনপি নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় এলেও বিশ্বজুড়ে ভারতীয় হেজিমনি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে ক্যাম্পেইন শুরু করবে তা মোকাবিলায় ইউনূস-তারেক মৈত্রী সহায়ক শুধু নয়, খুব প্রয়োজনীয় হবে বলেই আমার ধারণা। আমি জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের কেন্দ্রীয় চরিত্র ছাত্র-তরুণদের অ্যাকোমডেট করার আহ্বানও বিএনপি নেতৃত্বের প্রতি জানিয়ে আসছি। সেটা হলে ছাত্রদের নতুন দল গড়ার হয়তো প্রয়োজনই পড়ত না। যাই হোক, নতুন দল গঠনের ফলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়নি। প্রাণবন্ত গণতন্ত্রের জন্য নানা আদর্শ ও কর্মসূচিভিত্তিক দল থাকা খারাপ নয়। তবে সুষ্ঠু গণতন্ত্রের জন্য দলগুলোর মধ্যকার সম্পর্ক ও প্রতিযোগিতা হওয়া উচিত সুস্থ ধারার। হাসিনা রেজিমের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী দল ও শক্তিগুলোর সমন্বয়ে নির্বাচনের পর জাতীয় সরকার গঠনে বিএনপি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কাজেই নির্বাচনের আগে আন্দোলনকারী দলগুলোর মধ্যে একটা সমঝোতার উদ্যোগ নিতে বিএনপির আপত্তি থাকার কথা নয়। সেই বিবেচনা থেকে আমার প্রস্তাব, বিএনপি ছাত্রদের নতুন দলসহ আন্দোলনকারী দল-সংগঠনগুলোর একটি জাতীয় কনভেনশন আহ্বান করতে পারে। দু-তিন দিনব্যাপী সেই কনভেনশনে রাষ্ট্র ও রাজনীতিসংক্রান্ত বর্তমান এবং ভবিষ্যতের সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা ও বিতর্কের মধ্য দিয়ে একটি ন্যাশনাল চার্টার প্রণয়ন সম্ভব বলে আমি মনে করি। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরকারের গঠন করা ঐকমত্য কমিশনের বদলে জাতীয় সমঝোতার নেতৃত্ব বিএনপির হাতে আসার সম্ভাবনা আছে এবং এটি অনেক সুফল বয়ে আনবে বলে আমার বিশ্বাস।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক

ই-মেইল : mrfshl@gmail.com

Print Friendly, PDF & Email
 
 
জনতার আওয়াজ/আ আ
 

জনপ্রিয় সংবাদ

 

সর্বোচ্চ পঠিত সংবাদ