খালেদা জিয়ার রাজনীতি বিষয়ে মন্ত্রীদের বক্তব্য সম্পূর্ণ রাজনৈতিক - জনতার আওয়াজ
  • আজ সকাল ১০:২১, বৃহস্পতিবার, ১৮ই এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি
  • jonotarawaz24@gmail.com
  • ঢাকা, বাংলাদেশ

খালেদা জিয়ার রাজনীতি বিষয়ে মন্ত্রীদের বক্তব্য সম্পূর্ণ রাজনৈতিক

নিজস্ব প্রতিবেদক, জনতার আওয়াজ ডটকম
প্রকাশের তারিখ: শনিবার, মার্চ ৪, ২০২৩ ২:২৭ অপরাহ্ণ পরিবর্তনের তারিখ: শনিবার, মার্চ ৪, ২০২৩ ২:২৭ অপরাহ্ণ

 

সাক্ষাৎকার : জেড আই খান পান্না
ডেস্ক নিউজ

জেড আই খান পান্না নামে সমধিক পরিচিত জহিরুল ইসলাম খান পান্না বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী। তিনি বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের চারবার নির্বাচিত সদস্য; মানবাধিকার সংগঠন ‘ব্লাস্ট’-এর প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক সভাপতি। আইন পেশায় চার দশকের বেশি সময় অতিবাহিত করা এ জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর জন্ম ১৯৪৮ সালে।

সমকাল: আমরা সম্প্রতি দেখলাম, বিএনপিচেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার রাজনীতি করা নিয়ে সরকারের চারজন মন্ত্রী দুই রকম বক্তব্য দিয়েছেন। কেউ বলছেন– খালেদা জিয়ার রাজনীতি করার কোনো সুযোগ নেই। অপর মত– খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে কোনো আইনি বাধা নেই। বিএনপির বক্তব্য– বিষয়টি মূলত ক্ষমতাসীন দলের কৌশল। খালেদা জিয়ার রাজনীতি নিয়ে আপনার কাছে আইনি ব্যাখ্যা শুনতে চাই।

জেড আই খান পান্না: শুরুতেই বলতে চাই, এটি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত; রাজনৈতিক বক্তব্য। আমার যতদূর মনে পড়ে, আ স ম আবদুর রবের ক্ষেত্রে এমনটা হয়েছিল। এ ছাড়া সিরাজুল আলম খান ও হাসানুল হক ইনুর ক্ষেত্রেও ঘটেছিল একই ঘটনা। তাঁরা প্রত্যেকেই রাজনীতি করতে পেরেছিলেন। আমি যতটুকু আইনিভাবে বিষয়টি বুঝি, সেটি হলো, কেউ নৈতিক স্খলনজনিত কারণে সাজাপ্রাপ্ত হলে রাজনীতি করতে পারবেন না। আইনমন্ত্রী এর একটি যথার্থ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আইনমন্ত্রী হচ্ছেন দেশের আইন বিষয়ে সর্বোচ্চ স্বীকৃত ব্যাখ্যাকারী। তাই তাঁর বক্তব্য আমরা এখানে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখতে পারি। তিনি যদি বলে থাকেন– খালেদা জিয়া রাজনীতি করতে পারবেন; তাহলে পারবেন।

কিন্তু শুরুতে বলা হলো– খালেদা জিয়া রাজনীতি করতে পারবেন না। কারণ তিনি এই মর্মে মুচলেকা দিয়েছেন। সেখানে আইনমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রীর বক্তব্য কী নির্দেশ করে? মুচলেকার বিষয় কতটা আইনি?

জেড আই খান পান্না: আবারও বলতে চাই, পুরো বিষয়টি রাজনৈতিক। এ দেশে জেলে বসেও অনেকে নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন, এমন নজির আছে। আবার দণ্ডিত ব্যক্তিরা সংসদে আছেন– এমন উদাহরণও তো রয়েছে। বর্তমান সংসদেও তো দণ্ডিত ব্যক্তিরা ছিলেন, আছেন। তাহলে এখানে আইনে কী আছে আর কী নেই– এটা যে সব ক্ষেত্রে কাজ করে না, তা তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি।

এবার ভিন্ন প্রসঙ্গ। সম্প্রতি বিশেষায়িত বাহিনী র‍্যাব নিয়ে সরকারপক্ষ ও বিরোধীদের নানা বক্তব্য নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বিশেষ করে এ বাহিনীর কিছু সদস্যের বেআইনি কাজ নিয়ে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে র‍্যাবের বিলুপ্তির দাবি আসছে বিভিন্ন মহল থেকে। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?

জেড আই খান পান্না: ২০০৪ সালে তখনকার সরকার র‍্যাব গঠন করেছিল। সে সময়ে আমরা এর বিরোধিতা করেছিলাম। তখন এখনকার সরকার, যারা সে সময়ে বিরোধী দলে ছিল, তারাও আমাদের সঙ্গে সুর মিলিয়েছিল। এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে। সেই সময়ে যারা র‍্যাব প্রতিষ্ঠা করেছিল, তারা এখন র‍্যাবের বিলুপ্তি চায়। আবার সেই সময়ে যারা র‍্যাবের বিরোধিতা করেছিল, এখন তারাই র‍্যাবের গুণগান গায়। বিষয়টা হচ্ছে- যখন যার পক্ষে যেটি সুবিধা হয়, তখন সে তা করছে। এটা দেশের জনগণ বোঝে। জনগণকে এত অবুঝ ভাবার কারণ তো নেই।

বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ সংক্রান্ত ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধন বিষয়ে আপিল বিভাগের রায় নিয়ে একটি আলোচনা আছে দীর্ঘদিন ধরে। সন্দেহজনক কাউকে আটকের বৈধতা দিতে এই ধারাটি ব্যবহার করা হয়। এ বিষয়ে আইন সংস্কার কতটা দরকারি বলে মনে করেন?

জেড আই খান পান্না: ৫৪ ধারা বিষয়ে বলতে হলে বলা যায়, কাউকে সন্দেহ করে ধরা বা আটক করার একটি হাতিয়ার হিসেবে এটি চলছে। আবার দেখা যায়, কোনো একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আসামি করা হয় কয়েকজনকে। সেখানে বলা হয়, আরও কয়েকজন অজ্ঞাত আসামি ছিল। এটা করাই হয় খারাপ উদ্দেশ্য থেকে, যাতে কাউকে আটক করে অজ্ঞাত হিসেবে চালিয়ে দেওয়া যায়। আবার দেশে গুমের ঘটনা ঘটে। কথা হচ্ছে, একজন হলেও তো গুম হয়েছে। সেটা যে আমলেই হোক; গুমের ঘটনা ঘটেছে– এটিই সত্য। তা হতে পারে বিএনপি কিংবা বর্তমান আওয়ামী লীগের আমলে। একেবারে মিথ্যা কিছু তো আর ঘটে না। তবে মিথ্যা মামলা ঘটে।

মিথ্যা মামলা বন্ধে কী করা দরকার বলে মনে করেন?

জেড আই খান পান্না: মিথ্যা মামলা বন্ধ করলে মিথ্যা আসামি তৈরিও বন্ধ হবে। এখন আমাদের যে আইন, তা করেছিল ব্রিটিশরা। বিশেষ একটি কারণে তারা এ আইন করেছিল। এটি আমাদের সবারই জানা উচিত। যেমন আমরা বলতে পারি, ১৯৭২ সালে তো আর ডিজিটাল আইন হয়নি। এটি হয়েছে এখন, এই সময়ে এসে। এখনকার পরিপ্রেক্ষিতে ডিজিটাল আইন তৈরি হয়েছে। তেমনি ব্রিটিশরা আইন করেছিল সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে; সিপাহিদের শায়েস্তা করার জন্য। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ হয়েছিল– আমরা সবাই তা ইতিহাসে পড়েছি। ১৮৬০ সালে হয় দণ্ডবিধি আইন। এর পর ১৮৬১ সালে হয় পুলিশ আইন। অর্থাৎ যে আইন ব্রিটিশরা করেছিল বিদ্রোহী সিপাহিদের দমন করতে, সেই আইনেই এখন পুলিশ চলছে। সেই আইন দিয়েই পুলিশ আমাদের শায়েস্তা করে চলেছে। এখন আমি ১৯৭২ সালে সংবিধান রচনা করেছি; সেটি আরও কিছুটা সংযোজন-বিয়োজন করে আমার দেশ চলছে। সেই দেশ পরিচালনার সময়ে যদি মান্ধাতার আমলের ব্রিটিশদের তৈরি পুলিশ আইন মানা হয়, তাহলে তা কি মানানসই হয়? যে কারণে আমরা ৫৪ ধারার বিলুপ্তি চাই। কাউকে সন্দেহ হলেই গ্রেপ্তার কেন করবে? পুলিশ চাইলে পর্যবেক্ষণ করুক। সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ এনে তারপর গ্রেপ্তার করুক।

ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারাও বহুল সমালোচিত। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নিয়ে শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া যায় প্রায়ই…

জেড আই খান পান্না: ১৬৪ ধারার ভুক্তভোগী আমি নিজেই। যে কেউ চাইলে যে কোনো থানায় গিয়ে দেখতে পারেন সেখানকার পরিবেশ– থানা হাজত, কোর্ট হাজত বা জেল হাজত মানুষের থাকার উপযোগী কিনা। যেখানে সারাবিশ্ব একটি পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সেখানে আমাদের হাজতগুলো এমন থাকবে কেন? একটা সময়ে নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামে ছিল অপরাধীদের সবচেয়ে বড় আখড়া। সেখানকার কারাগার তাই খুব আলোচিত ছিল। এখন সেখানকার পরিস্থিতি বদলে গেছে। জেলখানায় মানুষকে কেন রাখা হয়? সংশোধনের জন্য। একটা মানুষ জেলখানা থেকে ফিরে আসে নিজেকে সংশোধন করে নতুন করে শুরুর সুযোগ নিয়ে। হত্যার বদলে হত্যা নয়; তার বদলে তাকে দিয়ে সমাজে কিছু ভালো কাজ করানো যেতে পারে। জীবন তো আর ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না। তাই তাকে দিয়ে যদি সমাজের কিছু ভালো কাজ করানো যায়, সেটা ভালো হয় না? কোনো সভ্য সমাজে কিন্তু আজকাল মৃত্যুদণ্ড নেই। কিছুদিন আগে আমেরিকায় একটি মামলায় এক ব্যক্তি ২৭ বছর বিনা বিচারে জেল খেটে বেরিয়েছেন। এমন ঘটনা আমাদের দেশেও হয়। এখন যদি এই লোকটিকে ২৭ কোটি টাকাও ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়, তাহলেও কি তা যথেষ্ট হবে? কোনো মানুষের জীবন থেকে যদি একটি বছরও কেড়ে নেওয়া হয়, তাহলে কি তা ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে? হবে না। কারও একটি দিনও ফিরিয়ে বা ক্ষতিপূরণ দেওয়া সম্ভব নয়। আমরাও চাই, আমাদের দেশে মৃত্যুদণ্ড কমে আসুক।

স্বীকারোক্তি আদায় নিয়েও তো আপত্তি পাওয়া যায়। রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের খবর প্রায়ই আসে।

জেড আই খান পান্না: আসামি স্বেচ্ছায় দোষ স্বীকারোক্তি দিতে রাজি হলে পুলিশ তাকে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে উপস্থাপন করে। ম্যাজিস্ট্রেট ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করেন। এই ধরনের জবানবন্দি সাক্ষ্য হিসেবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১৬৪ যদি আমরা দেখি তাহলে দেখব, এর আগে প্রায় ৯৯ শতাংশের রিমান্ডে নেওয়ার ঘটনা আছে। জবানবন্দি নেওয়ার ক্ষেত্রে আবার বলা হয়– আমি স্বেচ্ছায়, নির্বিঘ্নে, ভয়ভীতি না পেয়ে নিজেই জবানবন্দি দিচ্ছি। স্বেচ্ছায়ই যদি হবে; পুলিশের কাছে কেন আটক থেকে জবানবন্দি দিতে হবে! সেটা তো খোলা মাঠে, জনসমক্ষেও হতে পারে। সে জন্য আলাদা পুলিশ হেফাজতে নেওয়ার দরকার কী? সে জন্য তো জেলগেটেও জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে। এমন একটা উদাহরণও নেই, যেখানে মানসিক বা শারীরিক নির্যাতন না করে কারও জবানবন্দি আনা হয়েছে। হয়তো গায়ে হাত দেয়নি; কিন্তু ভয় দেখিয়ে বলেছে– তুমি স্বীকারোক্তি দাও। তা না হলে কিন্তু তোমার সন্তানদের খবর আছে! এভাবে স্বীকারোক্তি নেওয়া হয়।

সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আদালতের বিচারক ও আইনজীবীরা মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছিলেন। এ ঘটনায় বিচারপ্রার্থীরা দীর্ঘদিন ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। এমন ঘটনা কেন এড়ানো গেল না বলে মনে করেন?

জেড আই খান পান্না: উভয় পক্ষেরই আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখা উচিত ছিল। আইনজীবীরা প্রথমে একজন নাজিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে শুরুতেই ব্যবস্থা নেওয়া হলে ঘটনা এত দূর আসত না। সেখানে জাল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি বিক্রির সঙ্গে আদালতের নাজিরের জড়িত থাকার অভিযোগ শোনা যায়। এ কারণে মোমিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে জেলা জজের কাছে এবং দুর্নীতি দমন কমিশনে লিখিত অভিযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। যেহেতু আদালতে মামলা চলমান, আবার নতুন বিচারপ্রার্থীর বিষয়টি আছে, তাই সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে পড়েছে– এটা সত্য। কিন্তু এ বিষয়ে সাধারণ মানুষকে মুখ খুলতে দেখা যায়নি। কারণ সাধারণ মানুষ আসলে সংশ্লিষ্টদের প্রতি শ্রদ্ধা রাখতে পারছে না। আদালত অঙ্গন থেকে দুর্নীতি দূর করতে না পারার ফলে ন্যায়বিচার বিঘ্নিত হতে পারে। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, অন্য কোথাও দুর্নীতির শাস্তির বিধান থেকে বিচারাঙ্গনে দুর্নীতির শাস্তি বেশি হওয়া উচিত। কারণ একজন মানুষ জগতের আর কোথাও আশ্রয় না পেয়ে শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে আদালতে আসে এবং সেখানে যখন দুর্নীতির মাধ্যমে পরাজিত হয়– এর চেয়ে হতাশাজনক আর কিছু হতে পারে না।

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

জেড আই খান পান্না: ধন্যবাদ।
সূত্রঃ সমকাল

Print Friendly, PDF & Email
 
 
জনতার আওয়াজ/আ আ
 

জনপ্রিয় সংবাদ

 

সর্বোচ্চ পঠিত সংবাদ