মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বনাম গণতন্ত্রহীনতা
নিজস্ব প্রতিবেদক, জনতার আওয়াজ ডটকম
প্রকাশের তারিখ:
শুক্রবার, ডিসেম্বর ২৩, ২০২২ ৯:৩৮ অপরাহ্ণ পরিবর্তনের তারিখ:
শুক্রবার, ডিসেম্বর ২৩, ২০২২ ৯:৩৮ অপরাহ্ণ
ডক্টর মোর্শেদ হাসান খান
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের একান্ন বছর পার হলেও বাংলাদেশের জনগণ এখনো গণতন্ত্র উদ্ধারে রাজপথে সংগ্রাম করছে। অথচ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম আকাঙ্ক্ষা ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়েই শুরু হয়েছিলো মুক্তিযুদ্ধের।
ষাঠের দশকের ছাত্র আন্দোলন থেকে শুরু করে ছয়দফা দাবি ক্রমেই রূপ নেয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে। স্বাধীনতা পুর্ব সত্তরের নির্বাচনে যখন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ফল অস্বীকার করে সামরিক অভিযানের মাধ্যমে হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠে, তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘোষণা আসে। দল-শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিকামী বাংলাদেশিরা।
নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে জন্ম নেয় নতুন রাষ্ট্র – বাংলাদেশ। লক্ষ প্রাণের বিনিয়ময়ে পাওয়া রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মুল ভিত্তি ছিলো স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা। আর স্বাধিকারের প্রথম ধাপ গণতন্ত্র। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাবে দেশের শাসন ব্যবস্থা, এমনটি আমাদের প্রত্যাশা ছিলো মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের সেই বিকেলে। কিন্তু আজও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে রক্ত দিচ্ছে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ। একাত্তরের সংগ্রাম ছিলো সীমানার বাইরের পাকিস্তানি শোষকদের অনাচারের বিরুদ্ধে।
আজ পাঁচ দশক পেরিয়ে মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে এদেশীয় আওয়ামী লুটেরাদের বিরুদ্ধে যারা নির্বাচনে দেশের মানুষের ভোটাধিকারকে নির্বাসনে পাঠিয়ে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে আছে। দেশের মানুষ যখন উচ্চ মুল্যস্ফীতির চাপে পড়ে আছে, দেশের টাকা অবৈধভাবে বিদেশে পাঠিয়ে দেশের আর্থিক ব্যবস্থাকে ভেঙে দিয়েছে। সংবিধানের দোহাই দিয়ে যে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা চলছে, তার বিরুদ্ধেই গণতন্ত্রকামী মানুষের সংগ্রাম চলছে এখনো।
গণতন্ত্র হরণকারী কোনো রাজনৈতিক দলকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক বলার নৈতিক অধিকার কারো নেই। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্যি আামদের মুক্তিসংগ্রামে নেতৃত্ব দানকারী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের হাতে গণতন্ত্রের অপমৃত্যু ঘটেছে, একবার নয়, দুই বার। তাদের অবদানে বাংলা শব্দভাণ্ডারে যুক্ত হয়েছে দুটি শব্দ – বাকশাল এবং নৈশভোট। এই দুই অধ্যায় তাদের ঐতিহাসিক অর্জনগুলো ম্লান করে দেয়।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দেয়া দুই প্রজন্মই একই অপরাধে অপরাধী। সাথে আছে গুম, খুন, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ, মত প্রকাশে বাধাদান এবং দুর্নীতি। সবগুলোই একে একে সামনে এসেছে। বাকি আছে দুর্ভিক্ষ, যা এখন দরজায় কড়া নাড়ছে। এরকম স্ববিরোধী ঘটনা কেনো ঘটলো? সহজভাবেই উত্তর দেওয়া যায়। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়ার পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ অপরাপর নিকৃষ্ট স্বৈরাচারী শাসকদের মতো আচরণ শুরু করে – আজীবন ক্ষমতায় থাকার বাসনা, ক্ষমতা রক্ষার সহযোগী ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীসমুহকে অবাধে দুর্নীতিতে প্রশ্রয় দেয়া, সমালোচনার পথ রুদ্ধ করা, ব্যক্তি অথবা দলীয় স্বার্থে জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দেওয়া, নির্মমভাবে সমালোচক অথবা সরকার বিরোধীদের দমন এবং নিজেকে জনগণ দ্বারা নির্বাচিত সরকার প্রধানের বদলে পারিবারিক জমিদারির কর্তা মনে করা।
দুর্ভিক্ষের গ্লানি এবং দেশ পরিচালনায় ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন সরকার বাকশাল কায়েম করে গণতন্ত্র হরণের বন্দোবস্তব না করে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের মুখোমুখি হলে হয়ত বাংলাদেশের ইতিহাস অন্যরকম হতো। বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরে আসে শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীরউত্তম-এর উদ্যোগে এবং প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে যিনি ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রথা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে গ্রহনযোগ্য নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯১, ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালে তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে।
একইভাবে তৎকালীন ক্ষমতাশীন সরকার ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধান থেকে বিলুপ্ত করেন। তবে তারা নিজেদেরকে সমালোচনা থেকে আড়াল করতে বিচার বিভাগকে ঢাল হিসাবে ব্যাবহার করেন। এরপর দেশকে একটি ভোটারবিহীন এবং আরেকটি মধ্যরাতের নির্বাচন উপহার দেন।
বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীনে সকল নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলই জয়ী হয়েছে। অপর পক্ষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সকল নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল পরাজিত হয়েছে। এর কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। এর একটা বড় কারণ হচ্ছে নিরপেক্ষ নির্বাচনের আনুষঙ্গিক প্রতিষ্ঠানসমুহ দলীয় সরকারের অধীনে স্বাধীন ভবে কাজ করতে পারে না। নির্বাচন কমিশন তো দূরের কথা, বিচার বিভাগ পর্যন্ত স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারে না।
সরকার প্রধানের অনুগ্রহ লাভের আশায় প্রশাসনে লেজুড়বৃত্তির উদাহরণ আমাদের সবারই কম বেশি জানা আছে। এর বড় প্রমাণ সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অগণতান্ত্রিক ও সংবিধানবহির্ভূত আখ্যা দিয়ে তিনজন আইনজীবী হাইকোর্টে একটি রিট করেন। ২০০৪ সালে তিনজন বিচারপতি সমন্বয়ে হাইকোর্টের বেঞ্চ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বৈধ বলে রায় দেয়। তখন বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী। রিট আবেদনকারীরা এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যান।
আপিল বিভাগ বহু বছর পর শুনানি শুরু করেন যখন শেখ হাসিনা সরকার প্রধান। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে ছয় জন বিচারপতির বেঞ্চ গঠন কার হয় এবং তারা দেশের বিশিষ্ট আট জন সংবিধান বিশেষজ্ঞের বক্তব্য শোনেন। তাদের মধ্যে সাতজনই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিদ্যমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখার পক্ষে আদালতে অভিমত দেন। এমনকি বেঞ্চের তিনজন বিচারপতিও তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলবৎ রাখার পক্ষে ছিলেন।
সকলের সুপারিশ উপেক্ষা করে সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক এক তরফাভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অবৈধ বলে রায় দেন। সাথে সাথে হাস্যকরভাবে পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার সুপারিশ করেন। এর নাজরানা স্বরূপ: তিনি অবসরের পর তিন মেয়াদে নয় বছর ধরে আইন কমিশেনের চেয়্যারম্যানের পদে আসীন।
নিয়মবহির্ভূতভাবে অবসরকালীন আবস্থায় সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের রায়ে স্বাক্ষর করার সমালোচনা এবং ২০১৪ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচন নিয়ে শেখ হাসিনার সথে মতোবিরোধের অপরাধে তত্কালিন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে হেনস্তা করে পদত্যাগ এবং দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। পরবর্তীতে বিতর্কিত মামলায় তাকে এগারো বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি তাদের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে। কুখ্যাত ‘বাকশাল’ বাতিল করে জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্রের দ্বার উন্মোচন করেন। আর বেগম খালেদা জিয়া সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংযুক্ত করেন। দ্বিতীয় প্রজন্মের নেতা তারেক রহমান এখন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। নিশ্চিতভাবে আশা করা যায় রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে তিনি বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠানিক রূপ দিবেন।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আর যাই হোক নিজেদের ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’য় উজ্জীবিত দল হিসাবে দাবী করার নৈতিক অধিকার হারিয়েছে। একটি মানবাধিকার হরণকারী, গনতন্ত্র হত্যাকারী, দুর্নীতিগ্রস্ত, স্বৈরাচারী সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছে।
শেখ হাসিনা এখনো যদি জনগণের দাবি মেনে নিয়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজন করেন তবে দলীয় এবং ব্যক্তিগত সন্মান যতটুকু অবশিষ্ট আছে তা রক্ষা পাবে। নাহলে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের দেশ পরিচালনার ইতিহাস ‘কালো অধ্যায়’ হিসাবে বিবেচিত হবে। S